বলছেন চিকিৎসকরা

এবারের ডেঙ্গুর ধরন মারাত্মক, উদ্বেগের

প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
পাঁচ দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল ১৩ বছরের আর্জু, হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়লে বাবা-মা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে চিকিৎসকরা তাকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা অনুযায়ী স্যালাইন দেন। এখন সুস্থ হয়ে উঠছে ছেলেটি। আরেক শিশুও একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয় জ্বর নিয়ে, চোখে ঝাপসা দেখছিল সে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের রক্তে পস্নাটিলেট কমলেও তারটা ঠিকই ছিল। কিন্তু পরীক্ষায় তারও ডেঙ্গু ধরা পড়ে। শিশুটির চিকিৎসা চলছে। উভয় ক্ষেত্রেই ডেঙ্গুতে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়েছে। এটা খুবই বিরল। কিন্তু এখন আমরা প্রায়ই এই ধরনের ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি, বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক টিটু মিয়া। তিনি একে বলছেন ডেঙ্গুর 'ব্যতিক্রমী' চেহারা। এই অধ্যাপক বলেন, 'এখন এটা (ডেঙ্গু) মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, যকৃত ও কিডনির মতো নানা অঙ্গ আক্রান্ত করছে। খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে জ্বর চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে দেখছি।' চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পরেও অনেকে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ছে বলে জানান অধ্যাপক টিটু মিয়া। তিনি বলেন, 'ভালো হয়ে বাড়ি ফিরছে, কিন্তু কয়েক দিন পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আবারও শরীর থেকে তরল বেরিয়ে যেতে দেখছি আমরা।' এবারের ডেঙ্গু আগের চেয়ে মারাত্মক চেহারা নিয়ে আসার কথা জানিয়েছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এল ই ফাতমীও। মধ্য জুনে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর প্রথম হলি ফ্যামিলিতে এই রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড চালু করেছিলেন অধ্যাপক ফাতমী। ঢাকা মেডিকেলের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, 'এবার শুধু সংখ্যায়ই বেশি না। এবার প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমারজিক ফিভারে আক্রান্ত। এদের পঞ্চাশ ভাগেরই শক সিন্ড্রোম। এবার ডেঙ্গুর প্যাটার্নটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের সবার পস্ন্যাটিলেট কমে যাচ্ছে, সবাই শকে চলে যাচ্ছে। আগে সামান্য ডেঙ্গু হয়েই ভালো হয়ে যেত। এবার সবারই রক্ত লাগছে। এই পরিস্থিতিতে জ্বর হলে গাফিলতি না করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। অধ্যাপক টিটু মিয়া বলেন, জ্বর হলেই চিকিৎসকের কাছে যান। জ্বর সেরে যাওয়ার পরও কিছু দিন চিকিৎসকের ফলো আপে থাকুন। জ্বর না কমা বা অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকা, বমি হওয়া, পেটে তীব্র ব্যথা, রক্তক্ষরণ, মাথা ধরা, চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, ৪-৬ ঘণ্টা প্রস্রাব না হওয়া বা কম হওয়া, খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়া, নিদ্রাহীনতা ও আচরণের আকস্মিক পরিবর্তন ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ। অন্তঃসত্ত্বা, বৃদ্ধ, শিশু, সদ্যোজাত শিশু এবং ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, লিভার ও কিডনির রোগীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসায় বিশেষ নজর দিতে হয় বলে জানান টিটু মিয়া। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের আলাদাভাবে মশারির নিচে রেখে চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ দেন ঢাকা মেডিকেলের এই অধ্যাপক। তা হাসপাতালে অন্যদের মধ্যে এই রোগ ছড়ানো রোধে সহায়তা করবে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বাংলাদেশে প্রথম দেখা দেয় ২০০০ সালে, সে সময় এই রোগে মারা যান ৯৩ জন। তিন বছর পর থেকে ডেঙ্গুতে মৃতু্যর হার কমতে থাকে এবং কয়েক বছর এতে মৃতু্য শূন্যের কোটায় নেমে আসে। তবে গত বছর আবার ব্যাপকভাবে দেখা দেয় ডেঙ্গু, ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ২৬ জনের মৃতু্য হয় সরকারি হিসাবে। আর এ বছর সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই পর্যন্ত চার হাজার ৮৫২ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃতু্য হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য। তবে এই সংখ্যা ১০ জনের বেশি বলে বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে জুনের মাঝামাঝি থেকে। এরপর প্রায় প্রতিদিনই শতাধিক ডেঙ্গু ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ১৬১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন বলে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে জানা গেছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৮ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১০ জন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৮ জন, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ২১ জন, বারডেমে ১২ জন, বিজিবি হাসপাতালে ১৩ জন, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ১০ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১০ জন, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১২ জন, সালাহউদ্দিন হাসপাতালে সাতজন এবং পপুলার হাসপাতালে ৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ৯৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন ছিল বলে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মামুন মোর্শেদ জানান। তিনি বলেন, তাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য আলাদা দুটি ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর থেকে বেশি রোগী আসছে আমাদের এখানে। নারী ও পুরুষ রোগীর জন্য ৪০ শয্যার দুটি আলাদা ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। কিন্তু ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী হওয়ায় অনেককে মেঝেতে-বারান্দায় জায়গা দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার হলি ফ্যামিলিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮০ জনের মতো চিকিৎসাধীন আছে বলে জানান অধ্যাপক ফাতমী। এই হাসপাতালে আক্রান্তদের বেশির ভাগই শিশু। গত ১৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা জানিয়েছিল, জানুয়ারি থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ৫৫৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। তখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে দুইজনের মৃতু্য হওয়ার কথা জানিয়েছিল তারা। সে হিসাবে, গত এক মাসে ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজার ২৯৪ জন, যা গত বছরের এই সময়ের তুলায় প্রায় দ্বিগুণ। এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি কেন- এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া অ্যান্ড এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজেজ-এর ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে' মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে বেশি। এ কারণেই ডেঙ্গু বাড়ছে। প্রথম কথা হচ্ছে এ বছর ফেব্রম্নয়ারি থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া রাজধানীতে প্রচুর নির্মাণকাজ চলছে। অনেক বৃষ্টিপাত-বেশি তাপমাত্রা মশার প্রজননের জন্য বেশি সহায়ক ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও মশা বাড়ার একটা বড় কারণ। যে কারণে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। এছাড়া এবার আগের চেয়ে নজরদারি বেড়েছে। আমরা সব জায়গা থেকেই ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করছি। ফলে রোগীর সংখ্যাও আগের চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাড়ির ভেতরেও বিভিন্ন উৎসে এডিস মশা জন্মায়। এছাড়া বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের জলাধার, লিফটের নিচে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, টায়ার-টিউবসহ যেসব জায়গায় পানি জমে, সেগুলোই এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এরপরেও ডেঙ্গুর মশা নিধনে নগর কর্তৃপক্ষের বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এডিস মশা ঘর, পরিত্যক্ত বা নির্মাণাধীন ভবন যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে সেখানে বংশ বিস্তার করে। সুতরাং তারা সেখানে মশার ওষুধ ছিটাতে পারে এবং পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারপত্র, হ্যান্ডবিল বিলি করতে পারে, বলেন আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন দাবি করেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা 'সর্বোচ্চ শক্তি' নিয়োগ করেছেন। ঢাকায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করে আসা এই মেয়র সোমবার এক অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু নিয়ে 'বিভ্রান্তি' না ছড়াতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বানও জানান। ডেঙ্গু রোগীদের খোঁজ-খবর নিতে মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েও একই কথা বলেন তিনি। সাঈদ খোকন বলেন, 'ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরেও হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। কিন্তু আমরা বসে নেই। আমরা নগর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করে মাঠে আছি। অচিরেই শহরকে ডেঙ্গু মুক্ত করব। অন্যদিকে ওষুধে এডিস মশা নিধন না হওয়ায় তা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। নতুন ওষুধ না আসা পর্যন্ত বর্তমান ব্যবহৃত কীটনাশকের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।