ফেসবুকে নিন্দার ঝড়

মিন্নির পক্ষে আইনজীবী না দাঁড়ানো নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন

প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি
রিফাত হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করা হলেও তার পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আইনগত কিংবা সাংবিধানিক দিক বিবেচনায় মিন্নির পক্ষে আইনজীবী নিয়োগে কোনো বাধা নেই বলে দাবি তুলেছেন দেশের আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, আদালতে মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী না দাঁড়ানো সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, 'একজনের বিরুদ্ধে একটি খবর প্রকাশিত হলো, আর তাতেই সে অপরাধী হয়ে গেল, এটা ঠিক না। মামলা শুরুর পর সাক্ষী আসবে, শুনানি হবে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর নির্ধারণ হবে মিন্নি অপরাধ করেছেন কী না। এর আগেই আইনজীবীরা যা করেছেন তা কাম্য নয়, তার পক্ষে অন্তত একজন আইনজীবী থাকা উচিত ছিল।' মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী না দাঁড়ানোর ঘটনাকে দুঃখজনক এবং তার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে দাবি করেছেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, 'আইন এবং সংবিধানে বলা আছে, যেকোনো ব্যক্তি অপরাধী হোক বা না হোক, তিনি আইনগত প্রতিকার পাবেন। তবে তার অর্থ না থাকলে সরকার তাকে আইনজীবী দেবে।' এদিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর দাবি করেছেন, তিনি তিনজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, আদালতে তাদের দাঁড়ানোর কথা ছিল। তার মনে হয় প্রতিপক্ষের ভয়ে তারা তার মেয়ের পক্ষে দাঁড়াননি। মিন্নির বাবার ওই শঙ্কার বিষয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, 'অনেক সময় প্রভাবশালীরা তাদের বিপক্ষে আইনজীবীদের দাঁড়াতে বাধা সৃষ্টি করে। বরগুনায় যেহেতু আমরা আগে থেকেই জানি যে, ওই ঘটনার সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী জড়িত। তাই হয়তো এটাও ভাবতে পারি, তাদের (মিন্নির পক্ষে আইনজীবীদের) সামনেও হয়তো এমন বাধা এসেছে। সেটি হলে অবশ্যই প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। আবার চাইলে কোর্টও হস্তক্ষেপ করে হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এ বিষয়টিকে সবারই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। কেননা, সাংবিধানিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের আইনগত অধিকার ও আইনজীবী নিয়োগ করার অধিকার রয়েছে।' আইনগত দিক বিবেচনায় মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবীর না দাঁড়ানোর বিষয়টিকে অন্যায় বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না। আইনজীবীদের সনদ প্রদান ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অন্যতম এই সদস্য বলেন, 'মেয়েটি (মিন্নি) অপরাধী হলেও তার পক্ষে আইনজীবীদের দাঁড়ানো উচিত ছিল। ওই আইনজীবী সমিতিরও উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে আসার। অপরাধী যেই হোক, তার বিরুদ্ধে আইনজীবী দাঁড়াবে না, এটা সম্পূর্ণ নৈতিকতাবিরোধী এবং বার কাউন্সিল ও মানবাধিকারবিরোধী। আমেরিকার মতো জায়গাতেও ওয়ান ইলেভেনের ঘটনায় দোষীদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ হয়। আমাদের দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষেও আইনজীবী নিয়োগ হয়েছে। তাহলে মিন্নিরা কেন আইনজীবী পাবেন না? আমি মনে করি এটি বরগুনার আইনজীবী সমিতির দুর্বলতা।' তবে কোনো মামলায় আইনজীবীরা স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে আইন অনুযায়ী তাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া যাবে না বলেও জানান আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। এদিকে আইনজীবী না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান নান্টু দাবি করেন, মিন্নির পক্ষ থেকে কোনো আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। তিনি বলেন, 'কোনো আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ না করে, রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করে বেড়ালে তো আইনজীবী পাওয়া যাবে না।' এ বিষয়ে আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারি আসলাম বলেন, আসামিপক্ষ চাইলে আদালতের বিচারকের কাছে আর্জি জানিয়ে আইনজীবী পেতে পারেন। ফেসবুকে নিন্দার ঝড় এদিকে বুধবার আদালতে নেয়া হলে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী লড়তে রাজি না হওয়ার খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে। ফেসবুকে বিভিন্ন মন্তব্য ও প্রশ্ন রেখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বিভিন্ন জন। রাজনীতিক ও অধিকার কর্মী তাহেরা বেগম জলি তার ওয়ালে লিখেছেন- একজন আইনজীবী পাওয়ার অধিকারও মিন্নির নেই? 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কতিপয় দুর্বৃত্ত মিন্নিকে নিয়ে কুৎসিত প্রচারে মেতে উঠেছে। যা শত নারী ধর্ষণের সমান। আমরাও যখন এখানে মিন্নির ব্যাপারে স্বচ্ছতার দাবি তুলছি, তখনো দুই একজন ভদ্রলোক (!) বিকৃত নোংরা পদ্ধতিতে আমাদের সামনে হাজিরা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এই সেদিনও যে অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে নিয়ে এমনই বীভৎস খেলায় মেতে উঠেছিল সিরাজ বাহিনী, তা আসলে মনে থাকে না। আমরা ভুলে যাই, কিছু নরপশু দেখতে অবিকল মানুষের মতোই। নুসরাতের বিরুদ্ধে ঘাতক নিজে ধর্ষক সিরাজের পক্ষে ব্যানার নিয়ে রাজপথ দখল করেছিল। অবিকল কী না জানি না, তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি মিন্নির বিরুদ্ধেও কিছু অভিজাত দুর্বৃত্ত একইভাবে মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নুসরাতের বিরুদ্ধে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপারের ভূমিকা আমরা সকলেই জানি। ঠিক একই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে বরগুনাতেও। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! সেই ধর্ষক নুসরাত হত্যাকারী সিরাজের জন্য উকিলসমাজ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ধর্ষণের সাফাই গাইছে। আমরা তবে কোথায় যাব। তবুও সমগ্র নারী জাতির যা হয় হবে। কিন্তু যারা বাবা মা? তারা একটু ভাববেন না? এমন অসংখ্য উকিল তো আছেন, যারা কন্যাসন্তানের জনক-জননী। অন্তত তারা কেন দাঁড়াবেন না মিন্নির পাশে। আমি জানি না, বা এ পর্যন্ত বলিনি মিন্নি প্রশ্নবিদ্ধ নয়। কিন্তু এটুকু আমরা কেন দাবি করব না, মিন্নি আর ১০ জনের মতোই বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। মিন্নিকে নিয়ে যা ঘটছে, তাতে এই দাঁড়াচ্ছে, ওকে নিয়ে যা খুশি তাই করা যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের এক পরিচিত সম্ভ্রান্ত নারীকে খানসেনারা দড়ি দিয়ে ট্রাকের পেছনে বেঁধে গোটা মাগুরা শহর টেনে নিয়ে বেরিয়ে একসময় মৃত রক্তাক্ত ওই নারীকে নদীর ধারে ফেলে দেয়। আমাদের দেশের নারীদের নিয়ে খানসেনা এবং রাজাকারের সেই বীভৎস উলস্নাস কি আজও বন্ধ হবে না? তা না হলে মিন্নির জন্য বরগুনার একজন আইনজীবীরও কেন মনে হলো না, কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মস্তবড় অন্যায়। মিন্নিকে বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে যে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হলো, এটা স্বাধীন দেশের একটা কালো অধ্যায়!' সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির স্ট্যাটাস, 'মিন্নির পক্ষে স্থানীয় কোনো আইনজীবী লড়তে চাচ্ছে না কারণ হিসেবে তারা বলছে, এতে তারা বিতর্কিত হবে। আচ্ছা, মিন্নি কি একজন স্বীকৃত ধর্ষক? কিন্তু স্বীকৃত ধর্ষকের পক্ষেও তো আইনজীবীরা লড়তে কুণ্ঠবোধ করে না। আহা দুনিয়া!' সাংবাদিক রাজীব নূর তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, 'মেয়েটার পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়ালেন না। অথচ মিন্নির বাবা তার মেয়ের জন্য জিয়া উদ্দিন, গোলাম মোস্তফা কাদের ও গোলাম সরোয়ার নাসির নামে তিনজন আইনজীবীকে নিয়োগ করেছিলেন। তারা আদালতে দাঁড়াতে না পারার ব্যাখ্যা হিসেবে ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিতে না পারার অজুহাত দেখিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, আদালতে বিচারক মিন্নির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তার পক্ষে কোনো আইনজীবী রয়েছেন কী না? আমি আমার আইনজীবী বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে নিশ্চিত হয়েছি, তখন চাইলেই ওই তিনজন অনায়াসে নিজেদের মিন্নির পক্ষভুক্ত করে নিতে পারতেন। কেন তারা তা করেননি অনুমান করা কঠিন নয়। আমি বলছি না মিন্নি নির্দোষ। এমনটা দাবি করার কোনো সুযোগ আমার নেই। তবে মিন্নিকে দোষী সাব্যস্ত করা গেলে কার লাভ, সেটা আরও অনেকের মতো আমিও বুঝতে পারছি। মিন্নির বাবা ওর রিমান্ড শুনানির সময় কোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন এবং কাঁদছিলেন বলে বরগুনার এক সাংবাদিক বন্ধু বিকালেই জানিয়েছিলেন আমাকে। কার ভয়ে?' উলেস্নখ্য, গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় রিফাত শরীফকে। তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি হামলাকারীদের সঙ্গে লড়াই করেও তাদের দমাতে পারেননি। গুরুতর আহত রিফাতকে ওই দিন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উলেস্নখ ও পাঁচ-ছয় জনকে অজ্ঞাত আসামি করে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ২ জুলাই ভোরে মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।