নৌযানের বর্জ্যে দূষিত ৮ হাজার কিলোমিটার নদ-নদীর পানি

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

জাহিদ হাসান
দেশের নদ-নদীতে প্রতিদিন চলাচল করে অসংখ্য লঞ্চ ও নৌযান। এসব যানের সব ধরনের বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। এতে দূষিত হচ্ছে পানি -ফাইল ছবি
দেশের প্রধান নদীতে চলাচলকারী নৌযানে ফুডকোর্ট, লিফট, এসিসহ অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকলেও বর্জ্যের নূ্যনতম কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। এমনকি পয়ঃবর্জ্যও সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। অথচ নৌ-আইন অনুযায়ী লঞ্চে যাতায়াতকারীদের পয়ঃবর্জ্য রিজার্ভ ট্যাংকে সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশনে ফেলার নিয়ম রয়েছে। যেটি বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তর ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকলেও তারাও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে নদীর নাব্য অনুযায়ী বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে দেশের অভ্যন্তরে ৮ হাজার ছয় কিলোমিটার থেকে ৫ হাজার ১৫০ কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। এসব পথে ২১৬টি যাত্রীবাহী লঞ্চসহ ১২ হাজার ৪০৬টি নিবন্ধিত নৌযান চলাচল করছে। এর বাইরে অসংখ্য স্টিমার, ফেরি ও ট্রলার চলাচল করে। তবে নৌযানে পয়ঃবর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় সব ধরনের বর্জ্য নদীর পানিতে ফেলা হয়। সদরঘাট টার্মিনালে গিয়ে যাত্রী ও লঞ্চ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোতে আধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একক ও ডুপেস্নক্স কেবিন, ভিআইপি ফ্যামিলি কেবিন, লিফট, ফুডকোর্ট, ফ্রিজ, লকার, এলইডি টেলিভিশন, ওয়াই-ফাই সুবিধা, রোগীদের জন্য অক্সিজেন, সিসিইউ ইউনিট ও সিসি ক্যামেরা ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বালাই নেই। সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে বরিশাল ও চাঁদপুরগামী এক একটি নৌযান দেড় থেকে দুই হাজার যাত্রী পরিবহন করে। গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রায় একদিনের মতো সময় লাগায় ওইসব পরিবহনের যাত্রীরা সঙ্গে রাখা খাবারের প্যাকেট, পলিথিন, ডাবের খোসা কোমল পানীয়র বোতলসহ ময়লা-আবর্জনা ফেলার কোনো জায়গা নেই। এ কারণে এসব ময়লা-আবর্জনা নদীতেই ফেলছেন যাত্রীরা। লঞ্চগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটও নেই। যেসব টয়লেট রয়েছে এগুলোর মলমূত্র সরাসরি নদীতে পড়ছে। এছাড়া ইঞ্জিন ও জেনারেটরের পরিত্যক্ত তেলও নদীতে ফেলা হচ্ছে। অপচনশীল নানা বর্জ্যের কারণে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া ছাড়াও নদীর তলদেশ ভরাটের মাধ্যমে দেশীয় মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী, জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নদীর দূষিত পানি নামমাত্র পরিশোধন করে ওয়াসা কর্তৃক সরবরাহ ও ফসল উৎপাদনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করে মানুষ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় নদীগুলোতে বিশুদ্ধ পানি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনে বিস্তৃত নৌ-খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। যেখান থেকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করছে। অথচ প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ যাতায়াতকালে প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাত্যহিক শৌচকার্য এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলছে। তাই ক্রুটিপূর্ণ লঞ্চ বন্ধের পাশাপাশি আকাশ পথে বিমানের বর্জ্য অপসারণের মতো জনবহুল নৌ-পথে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হলে পরিবেশ দূষণ হ্রাস, জলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ছাড়াও সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি আক্রান্তের হাত থেকে বাঁচবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন যায়যায়দিনকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাত্রা পথের কঠিন ও মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনেক ধরনের সমাধান থাকলেও দুঃখজনকভাবে নৌ পরিবহনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়নি। এ কারণে নৌ সেক্টরের স্যানিটেশনে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। এতে করে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এমনকি নদী থেকে আরোহিত বিষাক্ত মাছ খাওয়া ও পানির ব্যবহারে মানুষ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে লঞ্চ-স্টিমারে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দ্রম্নত পদক্ষেপ গ্রহণে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিআইডবিস্নউটিএ-এর নজর দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) সৈয়দ নাজমুল আহসান যায়যায়দিনকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর জাহাজ ভাঙা বা নির্মাণে পরিবেশ ছাড়পত্র দিলেও এসব বাহন কর্তৃক দূষণ দেখভালের দায়িত্ব বিআইডবিস্নউটিএ'র। কারণ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত দপ্তর বিআইডবিস্নউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ) রুট-পারমিট দেয়। এর বাইরে পরিবেশ অধিদপ্তরের ল্যাবরেটরি শাখা নদীর পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরণ ও অধিদপ্তরের প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ নদীর জীববৈচিত্র্য এবং এনফোর্সমেন্ট শাখা অভিযান পরিচালনা করে। ফলে তারা ভালো বলতে পারবেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক ড. ফাহমিদা খানম যায়যায়দিনকে বলেন, 'মাসিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নদীর পানি পরীক্ষার জন্য ৬৬টি পয়েন্ট থেকে পানি সংগ্রহ করে অধিদপ্তরের ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণে মৌখিকভাবে বলা ও চিঠি দেয়া হয়েছে। এখন বাস্তবায়নের কাজটা বিআইডবিস্নউটিএ করবে। বিআইডবিস্নউটিএ'র চেয়ারম্যান কমোডোর এম. মাহবুব উল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, নৌযানের যাত্রীদের সলিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য শীঘ্রই ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য আউটসোর্র্সিং কোম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা লঞ্চের বর্জ্য সঠিক পদ্ধতিতে অপসারণ করবে। এছাড়া এখন থেকে নিবন্ধন দেয়ার পূর্বে নৌ অধিদপ্তর নতুন যানগুলোতে পয়ঃবর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করার কার্যক্রম গ্রহণ করতে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন (যাপ) সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দীন বীর বিক্রম দাবি করেন, ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য লঞ্চে ডাস্টবিন আছে। পরিত্যক্ত তেল নেয়ার জন্যও লোক রয়েছে। নতুন লঞ্চগুলোতে সঠিক পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো উপযোগী করে তৈরি করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।