মধু চাষে সফল সাতক্ষীরার করুণা রানী

প্রকাশ | ২১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
পরিশ্রম ও আগ্রহকে পুঁজি করে দিনের পর দিন এগিয়ে চলেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার এক মাত্র নারী মৌচাষি করুণা রানী সরদার (৫২)। ১৭ বছর যাবত সে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করে চলেছেন। করুণার বাড়ি সুন্দরবন-সংলগ্ন ইউনিয়ন মুন্সিগঞ্জের চুনকুড়ি গ্রামে। সে ভূপেন্দ্র নাথ সরদারের স্ত্রী। এলাকায় জনপ্রিয়তার কারণে গত কয়েক বছর পূর্বে তিনি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মৌবাক্সের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লালন পালন করে মৌমাছির স্বাভাবিক জীবনযাপনের সঙ্গে মিল রেখে মৌচাষ করে করুণা রানী এখন স্বাবলম্বী। মৌচাষের আয়ের মাধ্যমে করুণা এখন স্বল্প আয়তনের চিংড়ি ঘের মালিক, ইটের গাঁথনি দিয়ে বাড়ি করেছেন, জমি ক্রয় করেছেন ও সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এ ছাড়া দৈনন্দিন পরিবারের ব্যয়নির্বাহ চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে অধিক মুনাফা অর্জন অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ গ্রহণে করুণা রানী মৌচাষে এগিয়ে আসেন বলে জানান। ২০০৩ সাল থেকে অদ্যাবধি এই পেশার প্রতি অতি যত্নবান হয়ে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বামী ভূপেন্দ্র নাথ সব সময় তার পাশাপাশি থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে যাচ্ছেন। তার মৌচাষের খামারের নাম 'দাদু ভাই' মৌমাছি খামার। করুণা জানান, বিসিক ও প্রশিকার সহায়তায় চার প্রকারের মৌমাছি ডরসেটা, সেরেনা, ফোরিয়া ও মেলিফেরা জাত নিয়ে মৌচাষ চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে তার ১৭৫টি মৌকলোনি বা মৌবাক্স আছে। যেখানে মৌমাছির সংখ্যা রয়েছে ১০৫০টি। মধু উৎপাদনের সময় ও ফুল সম্পর্কে বলেন, যেহেতু মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে, সে কারণে বিভিন্ন ফুলের সময় বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পযর্ন্ত সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ হয়। এ সময় সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, মানিকগঞ্জ যেতে হয়। জানুয়ারি, ফেব্রম্নয়ারি মাসে রাইসরিষা, ধনিয়া, কালজিরা, তিল ফুলের মধু সংগ্রহে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল; মার্চ মাসে লিচু ফুলের মধু সংগ্রহে ঢাকা, গাজীপুর, কাপাসিয়া, নাটোর, ঈশ্বরদী, পাবনাসহ অন্যান্য স্থানে যেতে হয় এবং এপ্রিল ও মে মাসে সুন্দরবনের খলিসা, গরান, কেওড়া, বাইনসহ অন্যান্য ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয়। জুন মাসে কালোতিল ফুলের মধু সংগ্রহে ডুমুরিয়া ও অন্য স্থানে যেতে হয়। তিনি বলেন, এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুইজন কর্মচারী রেখেছেন। মৌচাষের আয় ও ব্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, যত বেশি মৌবাক্স বা মৌ কলোনি স্থাপন করা যাবে, আয়ের পরিমাণ ততো বেশি হবে। নভেম্বর থেকে জুন মাস পযর্ন্ত মৌবাক্স থেকে আয় করা সম্ভব হয়। জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পযর্ন্ত তেমন কোনো ফুলের সমারোহ না থাকায় মৌমাছি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। এ সময় তাদের কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। করুণা রানী বলেন, ১০টি মৌবাক্সের জন্য সপ্তাহে এক কেজি করে খাদ্য দিতে হয়, যার মূল্য আসে ৩০০ টাকা। এভাবে পাঁচ মাস খাদ্য দিতে হয়। করুণা রানী বেসরকারি সংগঠন বারসিক, প্রশিকা, সুশীলন থেকে এই মৌচাষের জন্য কিছুটা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তিনি বারসিকের সহায়তায় ভারতের তামিলনাড়ু যেয়ে মোম ও মধু দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। যেমন মোম দিয়ে লিপজেল, সাবান ও বাম এবং বিভিন্ন প্রকার আচার তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। তিনি ওয়াইল্ডটিমের সহায়তায় সুন্দরবন সুরক্ষায় অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক সফরে ভারতে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া মৌচাষের পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন সুরক্ষায় নিজ এলাকায় জেলে, বাউয়ালি, মৌয়ালিসহ অন্য পেশাজীবীদের নিয়ে উঠানবৈঠক, আলোচনা সভা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। এ জন্য তিনি ওয়াইল্ডটিমের পক্ষ থেকে 'বাঘবন্ধু' উপাধি পেয়েছেন। আরও জানা যায়, সমগ্র বাংলাদেশে তিনি একজন মাত্র সফল নারী মৌচাষি। উপজেলা কৃষি অফিসার আবুল হোসেন মিয়া বলেন, মৌচাষি করুণা রানী বাংলাদেশের একটি মডেল। তার সফলতা দেখে অনেক চাষি আগ্রহী হবে। করুণা রানীর সফলতায় কৃষি অফিস পাশে থাকবে বলে জানান।