দর কমায় জমজমাট রাজধানীর পশুর হাট

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
রাত পোহালেই ঈদ, তাই দেরি না করে অনেকে শনিবার কিনেছেন কোরবানির পশু। রাজধানীর তেজগাঁও পশুর হাট থেকে ছবিটি তোলা -ফোকাস বাংলা
ছুটির দিনে শুক্রবার রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা সমাগম না থাকায় বিক্রেতাদের মধ্যে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল শনিবার সকালেই তা অনেকটা এক ঝটকায় কেটে গেছে। নগরীর স্থায়ী-অস্থায়ী প্রতিটি পশুর হাটেই বেলা বাড়ার সঙ্গে পালস্না দিয়ে ক্রেতার ভিড় বেড়েছে। দুপুর না গড়াতেই প্রতিটি হাটই পরিণত হয় জনসমুদ্রে। সেই সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়েছে বেচাকেনাও। সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করে অধিকাংশ ক্রেতা ছোট-বড় কিংবা মাঝারি আকারের গরু কিনে ঘরে ফিরেছেন। স্বল্পসংখ্যক ক্রেতা কোরবানির পশু কিনতে না পারলেও বিক্রেতাদের সঙ্গে তাদের দরদামের ফারাক অনেকটাই কমিয়ে এনেছেন। হাট সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েকদিন ব্যাপারীরা আকাশচুম্বী দর হাঁকলেও শনিবার তারা মোটামুটি কিছু লাভ পেলেই গরুর দড়ি ক্রেতার হাতে তুলে দিয়েছেন। দরাদরির আকাশ-পাতাল ফারাক ঘোচায় ক্রেতারাও হাসিমুখে গরু-ছাগল কিনে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। তবে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শনিবার দুপুরের পরও যেভাবে ট্রাকে ট্রাকে গবাদি পশু এসেছে, তাতে শেষ মুহূর্তে বাজারদর কিছুটা পড়তির দিকে ঝোঁকার শঙ্কা রয়েছে। যদিও ব্যাপারীদের আশা, মোটামুটি ভালো দামে তারা গরু-ছাগল বেচে হাসিমুখে ঘরে ফিরতে পারবেন। বিশেষ করে যারা হাটে ছোট ও মাঝারি সাইজের দেশি গরু এনেছেন, তারা ভালোই লাভবান হবেন। গত কয়েক বছরের মতো এবারও এ ধরনের গরুই ক্রেতাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বলে জানান তারা। শনিবার সরেজমিনে আফতাবনগর, মেরাদিয়া, কমলাপুর, শাহজাহানপুর ও গাবতলী হাটে গিয়ে দেখা গেছে, দেশে পালা অস্ট্রেলিয়ান, ফ্রিজিয়ান কিংবা সিন্ধি জাতের ক্রসিং মোটাতাজা গরুর সামনে উৎসুক লোকজনের ভিড় থাকলেও এসব গরু বিক্রি কম হচ্ছে। সে তুলনায় দেশি ছোট ও মাঝারি আকারের গরু অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে। এসব গরুর দামও এখন সহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। একদিন আগেও যারা গরুর চড়া দর হেঁকে খুঁটি গেড়ে বসেছিলেন, তাদের সুরও অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। অতিরিক্ত দাম না চেয়ে বাজারের সঙ্গে তাল রেখে তাঁরাও তাদের গরুর দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। বিশেষ করে যারা বিশাল আকৃতির গরুগুলোর আকাশচুম্বী দাম হেঁকে যেসব গরুর ব্যাপারী এতদিন বাঁক ধরে ছিলেন, তারাও যেন এখন বাস্তব অবস্থা ঠাওর করতে পারছেন। অনেকেই এরই মধ্যে বুঝে গেছেন, এভাবে গো ধরে বসে থাকলে এসব গরু এবার বাড়িতেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই এ ধরনের গরু যারা এবার হাটে এনেছেন তারা অনেকটা উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন পশুর হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পশু কেনা-বেচায় কিছুটা সংশয় থাকলেও শনিবারের আবহাওয়ায় তা অনেকটা কেটে গেছে। সকাল থেকে হাটগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। বিকেলের পর সন্ধ্যা যতই গড়িয়ে আসছিল, হাটগুলোতে ক্রেতার সংখ্যাও ততই বাড়ছিল। এসব হাটের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহস্পতিবারের আবহাওয়া দেখে তারা যে শঙ্কা করেছিলেন, শুক্রবারের আবহাওয়ায় তা অনেকটাই কেটেছে। তবে এদিন হাটে ক্রেতা সমাগম না বাড়ায় অনেকে হতাশ হয়ে পড়ে। তবে শনিবারের ক্রেতার উপস্থিতিতে তাদের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে। তারা আশা করছেন, আবহাওয়া যাই হোক, এখন আর কেনা-বেচা নিয়ে তাদের কোনো শঙ্কা নেই। এদিকে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়ায় দেশি পশুর দাম চড়া থাকার যে আশঙ্কা ছিল, তা-ও কেটে গেছে বলে জানান বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, গত কয়েক বছরের মতো এবারও খামারিরা তাদের খামারে বিপুলসংখ্যক দেশি গরু লালন পালন করেছেন। সারা দেশে যেসংখ্যক কোরবানির গরু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি গরু মজুদ আছে। তাই চড়া দর হেঁকে বাঁক ধরে থাকলে হিতে-বিপরীত হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। আফতাবনগর হাটের হাসিল ঘরের সামনে কথা হয় মধ্য বাড্ডা পোস্টঅফিস গলির বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, যে গরুটি তিনি ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন, অন্য সময় এটির দাম সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা। তবে কোরবানির সময় এ দাম স্বাভাবিক। কিছুটা রুগ্ন হলেও এ গরুতে অন্তত সাড়ে ৪ মণ মাংস পাওয়া যাবে। তিনি আরও জানান, অনেকে বলছেন আর একদিন অপেক্ষা করলে আরও কম দামে গরু কেনা যাবে। তবে সেটা ঠিক বা ভুলও হতে পারে। যেহেতু আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দেয়ার মনস্থ করেছেন, তাই নিশ্চিত থাকতে কিছুটা বেশি দিয়ে হলেও পছন্দের গরুটি কিনেছেন। এ হাটে কয়েকজন ব্যাপারীর সঙ্গে ক্রেতার পশু দামাদামি করতে দেখা যায়। কুষ্টিয়ার ব্যাপারী আনোয়ার হোসেন জানান, তার আনা দু'টি ষাঁড় লালন-পালনসহ অন্যান্য খরচা বাবদ প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ ক্রেতারা চার লাখ টাকার কম দাম বলছে। অথচ তার একটি ষাঁড়ের সমান চারটি মাঝারি সাইজের গরু মানুষ আড়াই লাখ টাকা দিয়ে হাসিমুখে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আনোয়ারের ভাষ্য, মাঝারি আকারের দেশি গরুর চাহিদা এতো বেশি থাকবে জানলে তিনি এ ধরনের গরু না পুষে ছোট গরু কিনে লালন-পালন করতেন। রাজধানীর শাহজাহানপুর হাট ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতারা কোনো দালালের খপ্পড়ে না পড়ে সরাসরি কৃষক ও খামারিদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী দেশি ছোট ও মাঝারি আকারের কোরবানির পশু কিনছেন। হাটে ভারতীয় গরু না ওঠায় বিক্রেতারা অনেকটা স্বস্তিতে রয়েছেন। এ হাটে বিপুলসংখ্যক গরু আসায় ব্যাপারীরা চড়া দাম হেঁকে গরু ধরে রাখতে ভয় পাচ্ছেন। এ হাটে গরু কিনতে আসা বাসাবোর বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম জানান, হাটে বিপুলসংখ্যক দেশি গরু উঠেছে, দামও অনেকটা সহনীয়। বিক্রেতারা আগের মতো অতিরিক্ত দাম চাওয়া ছেড়ে দিয়ে সামান্য কিছু লাভ হাতে ধরে গরু বেচার চেষ্টা করছেন। হাটে দালালদের দৌরাত্ম্য না থাকায় বরাবর তিনি এ হাট থেকেই গরু কেনেন বলে জানান আমিনুল। এদিকে, মেহেরপুর থেকে ১০টি দেশি গরু নিয়ে এ হাটে আসা সাইফুলের দাবি, দেশি গরুর কদর বেশি হলেও, ক্রেতারা এর দাম ততটা দিতে চাচ্ছে না। গো-খাদ্যের উচ্চমূল্যের বাজারে দেশি গরু লালন-পালন করে তা বিক্রি করে লাভ করা খুবই কঠিন। তবে এবার ঢাকায় আসা ব্যাপারীদের লোকসানের মুখে পড়ার ভয় কম বলে মনে করেন তিনি। বনানী হাটের ব্যাপারী রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, পাবনা থেকে ২৩টি মাঝারি আকারের ষাঁড় তিনি বুধবার হাটে তুলেছেন। এর মধ্যে শুক্রবার রাত পর্যন্ত মাত্র একটি গরু বিক্রি হওয়ায় তিনি ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তবে শনিবার দুপুরের আগেই তার আরও ৫টি ষাঁড় বিক্রি হয়ে গেছে। রোববার দুপুরের মধ্যে তার বাকি গরুগুলোও বিক্রি হয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি। বড় ধরনের লাভ না হলেও যে দামে বিক্রি করেছেন, তাতে তিনি সন্তুষ্ট। তার ধারণা, রোববার ক্রেতার সংখ্যা আরও বাড়বে; বেচা-বিক্রিও ভালো হবে। তখন বেশি দাম পাওয়া যাবে। রাজধানীর অন্য হাটগুলোর তুলনায় শনিবার গাবতলী হাটে কেনাবেচা ছিল অনেক বেশি। এ হাটের ৮টি হাসিলঘরের সামনে সকাল থেকেই ভিড় দেখা গেছে। বেশিরভাগ মানুষ ৫০ থেকে ৯০ হাজার টাকার মধ্যে গরু কিনছেন। এ ছাড়া ছাগলের বেচাবিক্রিও ছিল ভালো। তবে বেশকিছু বিত্তশালী ব্যক্তিকে অস্ট্রেলিয়ান, ফ্রিজিয়ানা এবং সিন্ধি জাতের বিশাল আকৃতির ক্রস গরুও কিনতে দেখা গেছে। তবে মহিষ-উট-দুম্বার ক্রেতা ছিল একেবারেই হাতেগোনা। ঝিনাইদহ থেকে ১০টি গরু নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে হাটে এসেছেন ঝিনাইদহের জিলস্নুর রহমান। প্রতিটি গরু ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দাম হাঁকছেন। এরই মধ্যে ৬৫ হাজার ও ৭৮ হাজার ৫০০ টাকায় মাঝারি সাইজের দুটি গরু বিক্রি করেছেন তিনি। এই দামে সন্তুষ্ট কিনা জানতে চাইলে, তিনি 'হঁ্যা' সূচক উত্তর দেন। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যেই সবকটি গরু বিক্রি হবে বলে আশা তার। মেরাদিয়া হাটে কয়েকজন ক্রেতা বলেন, মোটা ও বিদেশি ক্রস গরুর চেয়ে তাদের বেশি পছন্দ দেশি মাঝারি গরু। আজকাল কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করা হয়। এসব গরুর মাংস স্বাস্থ্যগত দিক থেকে তারা নিরাপদ মনে করেন না। ভারত কিংবা মিয়ানমার থেকে আনা গরুর ব্যাপারেও তাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। এর চেয়ে দেশীয় খামার ও গৃহস্থের গোয়ালে পালা মাঝারি গরুর মাংস তাদের নিরাপদ মনে হয়। বনশ্রী থেকে গরু কিনতে আসা ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মোটাতাজা গরুর চেয়ে মাঝারি দেশি গরুর দামও কম। এগুলোর মাংস খেতেও সুস্বাদু। তারা সাতজন মিলে ৭০/৮০ হাজার টাকায় মাঝারি সাইজের দেশি গরু কিনে কোরবানি দেবেন বলে মনস্থ করেছেন। তবে গরুর ব্যাপারী ইজাজ মিয়ার দাবি, সব মোটাতাজা গরু খারাপ, ক্রেতাদের এমন ধারণা ঠিক না। কারণ স্টেরয়েড ট্যাবলেট না খাইয়েও অনেকে গরু মোটাতাজা করেছেন। যদিও এবারের হাটে এসব গরুও ক্রেতারা সহজেই কিনতে চাইছেন না। দেশি মাঝারি সাইজের গরুর বেচা-বিক্রি ও মুনাফা ভালো বলে জানান ইজাজ মিয়া। হাটের ভেতরে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্রেতাই দেশি মাঝারি আকারের গরুর খোঁজ করছেন। তবে আগে নাদুস-নুদুস গরুর দিকে সবার নজর থাকলেও এবার অনেকে পছন্দ কিছুটা হাড্ডিসার গরু। কেননা এসব গরু দেখতে কিছুটা রুগ্‌ণ মনে হলেও এর মাংসের ওজন বেশি। এছাড়া এসব গরুকে ক্ষতিকর কোনো ওষুধ খাওয়ানোর সম্ভাবনা কম।