শিশুটির কথা কে ভাববে?

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মা তাসনুভার সঙ্গে মেয়ে
যাযাদি রিপোর্ট মা-বাবার বিয়ে ভেঙে গেছে। ২ বছর ৯ মাসের মেয়ে শিশুটি এখন বাবার কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মা তার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চান। এ নিয়ে মামলা। শুনানি চলছিল ৮ আগস্ট। ঢাকার জজকোর্ট। হঠাৎ সেখানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। 'শাউটিং'। আদালত বিব্রত। বিচারক এজলাস ছেড়ে নেমে চলে যান। এ সময় আদালতে উপস্থিত ২৪ বছরের মা প্রথা ভাঙেন। তিনি নিজেই আদালতকে বলেন, 'মান্যবর জজ সাহেব, ঈদের আগে আমি কি এক দিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে পারি?' আদালত এ সময় বাবার আইনজীবী হিমাদ্রি শেখর দে তুষারকে এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলেন। জানা গেছে, শুক্রবার এটি নিয়ে গোল বেধেছে। কারণ, ওই দিনই শপিংয়ে যেতে উদ্যোগী হন মা। কিন্তু আইনজীবী জানিয়েছেন, বাবা সঙ্গে যাবে। কিন্তু সাবেক স্বামীর সঙ্গে যেতে রাজি নন মা তাসনুভা। ৮ আগস্ট শুনানির শুরু হয়েছিল ১১টার দিকে। ওই দিন শিশুটিকে আদালতে হাজির করতে আদালতের মৌখিক আদেশ ছিল। কিন্তু আদালতে জানানো হয় 'বৃষ্টিবাদলের' কারণে আনা সম্ভব হয়নি। কিছুক্ষণ শুনানির পর বিচারক দুপক্ষকে একটা সমঝোতা করে আসতে বলেন। বিরতির পর দ্বিতীয় দফা শুনানির একপর্যায়ে শোরগোল বাধে। যদিও মা-বাবার মধ্যে কোনো আপসও হয়নি। আদালতে আইনজীবীদের হট্টগোলের কারণে ছোট্ট শিশুটির ব্যাপারে পরে আর কোনো আদেশ আসেনি। মা-বাবার মতবিরোধ আর আইনজীবীদের হট্টগোলে শিশুটির কী হবে, তা নিয়ে কেউই তখন ভাবেনি। যদিও পরে আদালত এক অন্তর্বর্তী আদেশে বলেন, শুধু ঈদের দিন শিশুটি মায়ের কাছে থাকবে। আইনজীবী হিমাদ্রি শেখর বাবা সাদনানের আইনজীবী। শনিবার সকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, উভয়ের মধ্যে আপসরফার চেষ্টা করছেন তিনি। আদালতের অভিপ্রায় তেমনই। হিমাদ্রি ইঙ্গিত দেন যে শপিংয়ে হয়তো শিশুটির সঙ্গে তাকেই থাকতে হতে পারে। ওই দিন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী বলেন, বিচারকের সামনেই 'চিলস্নাচিলিস্ন' করে আদালতে কাজে বাধা সৃষ্টি করেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) সাইফুল ইসলাম। বিচারকের এজলাস ত্যাগের পরে হাতাহাতিও হয়েছে। এই মামলার তাসনুভার অন্যতম আইনজীবী ফয়সাল সিদ্দীকিও আদালতে হট্টগোল ও হাতাহাতির কথা জানান। অ্যাডভোকেট সিদ্দীকি বলেন, ওই এপিপি মহানগর আদালতের। সেটি ভিন্ন ভবনে। সেখান থেকে এসে তাকেও লাথি মেরে ফেলে দেয়ার কথা বলেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে সিদ্দীকি বলেন, 'আমরা আপসের জন্য কথা বলেছিলাম। তারা বললেন, মেয়েকে তারা ঈদের ছুটিতেও দেবেন না। আর লিখিত আদেশ না দেয়ার কারণে তারা মেয়েকে আদালতে হাজির করেননি বলেও যুক্তি দেন। অবশ্য দায়িত্বশীল একটি সূত্র দাবি করেছে, শিশুটির মায়ের পক্ষে বৃহস্পতিবার ৩০ জনের বেশি আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাবার পক্ষের আইনজীবীদের আশঙ্কা ছিল, শিশুটিকে হাজির করা হলে তারা তাকে তুলে নিতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটেই ওই এপিপিকে ডেকে আনা হয়। \হশিশুটিকে আদালতে আনার নির্দেশ অমান্য করা ঠিক হলো? এই প্রশ্নের জবাবে এপিপি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'ঠিক হইছে না হইছে আদালত রায় দেবেন। আদালতের আদেশের ভায়োলেশন হলে আমার কিছু করার নেই। আমি ভায়োলেশন করলে আদালত আমার বিরুদ্ধ অ্যাকশনে যাবেন। আদালত আদেশ দিয়েছিলেন, মৌখিকভাবে বলেছিলেন, আমি এই যে মৌখিকভাবে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এর কি কোনো ভিত্তি আছে? আদালতের প্রতিটি লিখিত আদেশ মানতে আমরা বাধ্য। লিখিত আদেশ দিলে কারও কিছু করার নেই। তবে আমরা হাজির করতে বলেছিলাম। শাউটিংয়ের কারণে মামলাটির শুনানি হয়নি। কোর্ট বিব্রত হয়ে উঠে গেছেন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়েছে।' ঈদের দিনে মায়ের কাছে ছোট্ট শিশুটির থাকার ধারণাটি সম্পর্কে এই আইনজীবী বলেন, বাচ্চাটা যার, সে কোন পরিবেশে বড় হবে, সেটা দেখার দায়িত্বও তার। কেননা ভরণপোষণ তিনিই করবেন। আদালতে হট্টগোল প্রসঙ্গে সাইফুল ইসলাম বলেন, 'যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তাদের থানায় যেতে বলেন। মামলা করতে বলেন। হাইকোর্টে রিট করতে বলেন।' আদালতে হাতাহাতির বিষয়ে তিনি বলেন, 'কার চেহারায় রক্ত বেরিয়েছে, বলেন? তাহলে হাতাহাতি করব কোথায়? কোর্টের ভেতরে কথা-কাটাকাটি হবে, আইনজীবী রিপন, শুনানিকালে নীতি-নৈতিকতা নিয়ে শাউটিং করেছেন। আমি তখন বলেছি, আপনি শাউট করছেন কেন? আমি বলেছি, আপনি শাউট করবেন না। শাউট করার জায়গা এটা না। আর কোর্টের ভেতরে অনেক কথা হবে। বেরিয়ে আবার তারা গলাগলি করে প্রেম করবেন। ক্লায়েন্টকে খুশি করতে গিয়ে আইনজীবীরা অনেক কিছু বলেন, কারণ ক্লায়েন্টরা তাদের ফি দেন। একজন লইয়ার আরেকজন লইয়ারের গায়ে কোনো দিন হাত দেবেন না। ক্লায়েন্টকে দেখানোর জন্য অনেক কিছুই করেন, কিন্তু মারধর করেন না।' ঢাকার যে অতিরিক্ত জেলা জজের কোর্টে তর্কাতর্কি হয়েছে, সেই আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল কাউয়ুম। তিনি বলেন, 'তর্কাতর্কির' বিষয়টি পরে মিটমাট হয়ে গেছে। জজ সাহেব নেমে যাওয়ার পরে তিনি কিন্তু উভয় পক্ষকে এজলাস থেকে বের করে দেন। ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে বলেন, 'বিচ্ছেদ হওয়া দম্পতির ৫ বছরের কম বয়সি সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকবে। নাবালক সন্তান বাবার 'ব্যক্তিগত দখলি সম্পত্তি' নয়। বাবা নাবালক সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবক হতে পারে। কিন্তু সন্তানের নয়। শিশু কোনো বল নয় যে সে বাবা-মায়ের মধ্যে বাউন্সড হবে।' বোম্বে হাইকোর্ট 'মা কোনো উপযুক্ততা দেখাতে পারেননি', এমন যুক্তিতে দুই বছরের শিশুর অভিভাবকত্ব বাবাকে দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট তা নাকচ করেন। মা আপিলে জয়ী হন। এ ব্যাপারে আইনজীবী এলিনা খান শুক্রবার বলেন, ভিন্নরূপ কোনো শক্তিশালী কারণ না থাকলে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইন ও উচ্চ আদালতের রায়ে এটা মীমাংসিত যে ডিভোর্সি মা দ্বিতীয় বিয়ে না করলে ছেলেশিশুকে অনধিক ৭ বছর এবং মেয়েশিশু প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত রাখতে পারবেন। নাবালক সন্তানেরা মায়ের হেফাজতেই থাকবে। তবে অভিভাবকত্ব ও ভরণপোষণসহ সন্তান দর্শনে বাবার অধিকারও অটুট থাকবে। উলেস্নখ্য, এই মামলায় মা-বাবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে মেয়ের অভিভাবকত্বের দাবিতে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন মা তাসনুভা শান্তাজ (২৪)। অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ হয়, বাবা সাদনান সারোয়াত (২৫) তার নাবালিকা মেয়েকে সপ্তাহে চার দিন প্রতিদিন সকালে মায়ের কাছে রেখে সন্ধ্যায় নিয়ে যাবেন। সাদনান এই রায়ের বিরুদ্ধে জজকোর্টে আপিল করেন। যুক্তি হলো, তার পক্ষে এটা অসুবিধাজনক। আনা-নেওয়ার দায়িত্বটা পালন করবেন মা। সেই মামলারই শুনানি চলছে। গত ১২ জুন তাসনুভা পলস্নবী থানায় এই মর্মে ডায়েরি করেন যে 'তার সাবেক স্বামী মাদকাসক্ত। যেকোনো সময় তার অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। মেয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ১১ জুন দেখতে গেলে তাকে বাসায় ঢুকতে দেয়া হয়নি।'