পোস্তায় চামড়া কেনা শেষ, এখন অপেক্ষা ট্যানারিতে পাঠানোর

এবার চামড়ার দাম কম ও হাজার হাজার পিস চামড়া নষ্ট হওয়ায় চামড়া শিল্প প্রায় হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়তে পারে

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
লবণ মাখানো চামড়া -যাযাদি
পোস্তায় চামড়া কেনা শেষ। এখন ট্যানারিতে পাঠানোর অপেক্ষায়। গত তিন দিনে লাখ লাখ পিস চামড়া কেনাবেচা হয়েছে পোস্তায়। শতাধিক আড়তদার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা চামড়া কিনে গুদাম বোঝাই করেছেন। সেই চামড়ায় লবণ মাখানোর পর এখন শুধু ট্যানারি মালিকদের অপেক্ষা করছেন আড়তদাররা। এবার চামড়ার দাম কম ও হাজার হাজার পিস চামড়া নষ্ট হওয়ায় রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। ফলে এ শিল্পে প্রায় হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঈদের চতুর্থ দিন পোস্তায় কাঁচা চামড়া না আসায় বিক্রেতা, আড়তদার ও কর্মচারীদের ব্যস্ততা না থাকলেও হতাশা ছিল ব্যবসায়ীদের চোখে-মুখে। এখনো কোনো কোনো আড়তে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে লবণ দেয়ার কাজ চলছে। আড়তে চামড়া লবণজাত অবস্থায় থাকবে ২০ থেকে ২৫ দিন। এরপর ২০ আগস্ট থেকে পোস্তার চামড়া নেবেন ট্যানারি মালিকরা। এবার চামড়ার দরপতনের এ পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি ও আড়তদাররা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। একই সঙ্গে রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনাসহ সিন্ডিকেটের অভিযোগ। আড়তদাররা জানান, চামড়া দেশের সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। গুণগতমানের দিক থেকেও বাংলাদেশের গবাদি পশুর চামড়া উন্নতমানের। আর সে কারণে একসময় বিদেশি ক্রেতারা এদেশ থেকে চামড়া কিনত। অথচ এখন তারা বাংলাদেশবিমুখ। এর কারণ সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। চামড়াশিল্পকে টিকিয়ে রাখা শুধু নয় বিকশিত করতে হলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে পাটশিল্প যেমন ধ্বংস হয়ে গেছে, চামড়া শিল্পও ধ্বংস হয়ে যাবে। এদিকে গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়। এর পরদিন ১৪ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০ আগস্টের মধ্যে চামড়া কেনার অনুরোধ জানালে ট্যানারি মালিকরা সরকারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই চামড়া কেনার সিদ্ধান্ত নেন। তবে হঠাৎ করে সরকারের নেয়া এ সিদ্ধান্তে এ শিল্প খাতের কোনো উপকার হবে না বলে মনে করেন আড়তদাররা। কারণ যা ক্ষতি হওয়ার গত কয়েকদিনেই হয়ে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, পোস্তায় চামড়া কেনা শেষ। লবণ মাখানো প্রায় শেষ। দু-একটি কারখানায় হয়তো লবণ দিচ্ছে। এখন তারা অপেক্ষা করছেন ট্যানারি মালিকরা কবে থেকে চামড়া কিনবেন। ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ২০ আগস্ট থেকে লবণযুক্ত চামড়া কিনতে বলেছে। তারাও এ সিদ্ধান্তে রাজি হয়েছে। আশা করেন তারা তাদের কথা রাখবে। তিনি বলেন, বাজারে কোনো সিন্ডিকেট হয়নি। প্রতি বছর ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেটের কথা বলেন, কিন্তু এটি সঠিক নয়। সমস্যা হয় তাদের কাছে পাওনা টাকা যখন তারা পান না তখনই। তারা প্রচুর টাকা বকেয়া রেখেছেন। সবার কাছে টাকা থাকলে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকত, ফলে চামড়ার দামও বাড়ত। এজন্য তারা বারবার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বলেছেন চামড়া কেনার ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিয়ে রাখতে। যদি তারা এটা করত তাহলে এত চামড়া নষ্ট হতো না। যে পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়েছে তাতে আনুমানিক প্রায় হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে এ শিল্পের। পোস্তার আড়তদার ছমীরউদ্দিন বলেন, 'আমি ৩০ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করি। এবারের মতো দরপতন কোনোদিনও দেখিনি।' এবার তিনি তিন হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছেন। মানভেদে ৩শ টাকা থেকে ৮শ টাকা পর্যন্ত দরে চামড়া কিনেছেন। আর চামড়াপ্রতি তার খরচ হয়েছে ২৫০ টাকা। এ খরচের মধ্যে রয়েছে লবণ মাখানো, গাড়িতে করে চামড়া আনা ও লবণ খরচ। সরকার নির্ধারিত ৪৫ থেকে ৫০ টাকা ফুট বিক্রি করতে পারলে লাভবান হবে আড়তদাররা। তিনি বলেন, 'এবার চামড়া কম দামে কিনেও ঝুঁকিতে আছি। এখনো কোনো ট্যানারি যোগাযোগ করেনি। আশা করছি, আগামী ২০ আগস্ট থেকে চামড়া নেয়া শুরু করবে ট্যানারি মালিকরা।' আড়তদার আজগর আলী বলেন, 'এতদিন ধরে ব্যবসার সঙ্গে আছি কিন্তু এত বাজে ব্যবসা আর কখনো দেখিনি। এখন মাল কেনা শেষ। ট্যানারিতে সাপস্নাই দেয়া বাকি। মঙ্গলবার থেকে ট্যানারি মাল টানা শুরু করবে। তারা যদি আমাদের নগদ টাকা না দেয় তাহলে মাঠেই মারা পড়ব আমরা।' সূত্রে জানা যায়, পোস্তায় চামড়া কেনা ও চামড়ায় লবণ দেয়া শেষ হয়েছে। এবার আড়তদাররা সরাসরি চামড়া না কেনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দিয়ে চামড়া কিনছেন। তারা কম দামে চামড়া কেনার জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা চামড়া নিয়ে রাস্তায় বসে থাকতে বাধ্য করে। পরে চামড়া নষ্ট হওয়ার আতঙ্কে নামমাত্র দামে লোকসান দিয়ে চামড়া বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। ফলে সরকার নির্ধারণ করে দেয়া দর অনুযায়ী লবণ মিশ্রিত চামড়া ২০ থেকে ২৪ বর্গফুটের একটি চামড়ার দাম হওয়ার কথা ৮শ থেকে এক হাজার টাকা। সেখানে লাভের আশায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাসাবাড়ি থেকে চামড়া কিনেছেন ৫শ থেকে ৬শ টাকা দরে। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েন তারা। আড়তদাররা চামড়া কেনার টাকার অভাব আর সংরক্ষণের কথা বলে বেকাদায় ফেলে দিচ্ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। আর কম দামে কিনে মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফা রেখেই সেই চামড়া বিক্রি করেন আড়তদারদের কাছে। যা পরে আড়তদাররা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে ট্যানারি মালিকদের কাছে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করবে। এভাবেই চামড়ার বাজারে দরপতন হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। সরকারের নির্ধারণ করে দেয়া দাম অনুযায়ী ঢাকায় কোরবানির গরুর প্রতিটি ২০ থেকে ৩৫ বর্গফুটের চামড়া লবণ দেয়ার পরে ৯শ থেকে এক হাজার ৭শ ৫০ টাকায় কেনার কথা ট্যানারি মালিকদের। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩শ থেকে ৫শ টাকায় চামড়া কিনেছেন। আর রাজধানীর বাইরে দেশের অন্য স্থানে চামড়া বেচা-কেনা হচ্ছে আরও কম দামে।