আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকের বেহালদশা

মূলধন ঘাটতি, জনবল সংকট ও টানা লোকসানের কারণে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধের সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকটি। এ অবস্থায় মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে ১৫০ কোটি টাকা চেয়েছে তারা

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

ইমদাদ হোসাইন
প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানামুখী সংকটে জর্জরিত বিশেষায়িত আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক। এক কথায় বলা যায়, জন্ম থেকে জ্বলছে প্রতিষ্ঠনটি। বর্তমানে ব্যাংকটির প্রায় বেহালদশা। মূলধন ঘাটতি, জনবল সংকট ও টানা লোকসানে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধের সক্ষমতাও হারিয়েছে আনসার-ভিডিপি ব্যাংক। তবে সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যাংক খাতের চলমান অস্থিরতার মধ্যেও বিশেষায়িত ব্যাংক থেকে পূর্ণাঙ্গ তফসিলি ব্যাংকে বা বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে চায় আনসার-ভিডিপি ব্যাংক। এ জন্য মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে ১৫০ কোটি টাকাও চেয়েছে ব্যাংকটি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে ব্যাংকটির নানা সংকট তুলে ধরে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ। ওই চিঠিতে বিশেষায়িত ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগসহ গ্রামীণ ব্যাংকের মতো করপোরেট ট্যাক্স থেকে অব্যাহতির দাবি জানিয়েছেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ জুলাই ব্যাংকের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, চলতি বছর আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩৯তম জাতীয় সমাবেশে ব্যাংকের স্টল পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি ব্যাংকটিকে তফসিলি ব্যাংকে রূপান্তরে মূলধন বাবদ ১৫০ কোটি সরকারের তহবিল হতে দেয়ার ইতিবাচক সম্মতি জানান। চিঠিতে আরও বলা হয়,সারাদেশে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৬১ লাখ সদস্য ও তাদের পরিবার মিলে প্রায় আড়াই কোটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) লক্ষ্য অর্জনে বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য আধুনিক সুবিধা সংবলিত তফসিলি ব্যাংকিং সেবা চালু করতে ব্যাংকটিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তর করা প্রয়োজন। এজন্য মূলধন বাবদ ১৫০ কোটি টাকা পুনর্গঠন তহবিল জরুরি দরকার। এছাড়া পৃথক আরেকটি চিঠিতে ব্যাংকের করপোরেট ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে। এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জানান, কার্যক্রম শুরুর পর প্রায় ৭ বছর ক্রমাগত লোকসানে চলছে ব্যাংকটি। ২০০২-০৩ অর্থবছর থেকে সীমিত অঙ্কে মুনাফা অর্জন শুরু করে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পুঞ্জীভূত করপোরেট ট্যাক্স বাবদ ব্যাংকের বিপরীতে ৫৪ কোটি ধার্য হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকটির আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় অদ্যাবধি কোনো করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুঞ্জীভূত সব করপোরেট ট্যাক্স মওকুফ করা না হলে ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে মাঠ পর্যায় থেকে তহবিল তুলে পরিশোধ করতে হবে। ফলে বাহিনীর নিম্ন আয়ের বিশাল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত এ ব্যাংকের কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হবে বলে চিঠিতে বলা হয়। ব্যাংকটির সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাহবুবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, এ ব্যাংকের সঙ্গে দেশের আড়াই কোটি জনগোষ্ঠী সরাসরি জড়িত। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে ব্যাংকটি। তিনি বলেন, তফসিলি ব্যাংকভুক্ত হলে আমানত রাখার পাশাপাশি ঋণ কার্যক্রম বাড়বে। যার সুফল সবাই পাবে। প্রতিটি উপজেলায় শাখা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবাসহ সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও জানান, তাদের ৬১ লাখ আনসার-ভিডিপির উন্নয়ন করতে হলে তফসিলি ব্যাংকের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের কাছে তহবিল চাওয়ার কারণ হচ্ছে- সংকট থেকে উত্তরণে ব্যাংকটিকে বাণিজ্যিকীকরণ করা। তিনি বলেন, ১০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে একটি ব্যাংক চলতে পারে না। আনসাররা ১০০-২০০ টাকায় শেয়ার কিনে ২৩ বছরে জমা করেছে মাত্র ৩২ কোটি টাকা। ৩২ কোটি টাকা দিয়ে বিশাল বাহিনীর এ ব্যাংক চলতে পারে না। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটি সারাদেশে ১৮টি অঞ্চলে ২৪১টি শাখা পরিচালিত হচ্ছে। অনুমোদিত ১ হাজার ৩৬০ জনবলের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছে ৯১২ জন। প্রতিষ্ঠার ২২ বছরেও ব্যাংকটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। সেজন্য তফসিলি ব্যাংকে রূপান্তরিত হলে আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক অন্য ব্যাংকের মতো কার্যক্রম চালাতে পারবে এবং মুনাফাও বাড়বে। যার সুফল পাবে প্রতিটি আনসার সদস্য। ব্যাংক সূত্রমতে, পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৭ সালে বাহিনীর ৩৭তম জাতীয় সমাবেশে ব্যাংকের ১ লাখ টাকার শেয়ার কিনে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটিতে সরকার আরও ১০ কোটি টাকা দিয়েছে। ওই সময়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অংশে মূলধন বেড়েছে আরও ১১৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ৩০ জুন পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্যা অনুযায়ী-২২ বছরের পুরাতন এ ব্যাংকটিতে সরকারের ২৫ শতাংশের শেয়ার হিসেবে ১০০ কোটি টাকা দেয়ার কথা। কিন্তু ওই সময় পর্যন্ত সরকারের পরিশোধিত মূলধন ৮৫ কোটি টাকা। এখনো সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানটি পাবে আরও ১৫ কোটি টাকা। এছাড়া আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৭৫ শতাংশ মালিকানা হিসেবে ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৫২ কোটি ৫৮ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রয় করা সম্ভব হয়েছে। অপরিশোধিত রয়েছে আরও ১৪৭ কোটি কোটি ৪২ লাখ। ফলে ব্যাংকটি পরিচালিত হচ্ছে মাত্র ২৩৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যার কারণে ব্যাংকটি বিভিন্ন তফসিলভুক্ত ব্যাংক হতে উচ্চ হার সুদে অর্থ আমানত হিসাবে এনে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বিশেষায়িক ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। আনসার ও গ্রাম-শিক্ষা বাহিনীর বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র প্রায় ৬১ লাখ সদস্যের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ তাদের দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকটি কাজ করছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ২০ বছরে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ১০৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে মালিকানার অংশ হিসেবে সরকারের ৭৫ কোটি টাকা। আর আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য এবং ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা- কর্মচারী শেয়ারহোল্ডার হিসেবে দিয়েছেন ৩২ কোটি ৬২ লাখ টাকা।