মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তি

ধ্বংসস্তূপে সব হারানো মানুষের কান্না, আর্তনাদ

ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুনে প্রায় ৫০০-৬০০ ঘর পুড়ে গেছে, আর এতে প্রায় তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
শুক্রবার রাতে রাজধানীর মিরপুরের চলন্তিকা মোড়সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে শত শত মানুষ। ছবিতে সব হারানো একটি পরিবারের কয়েকজন সদস্য ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে আছেন -যাযাদি
নগরীর নিম্নবিত্ত মানুষের আবাস বস্তি। যেখানে সাধ্যের মধ্যে শত-সহস্র স্বপ্নের মেলবন্ধন ঘটান তারা। ছোট-ছোট ঘরগুলোতেই সুখের নীড় বাঁধেন সমাজের নূ্যনতম চাওয়া-পাওয়ার মানুষগুলো। তবে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে সাধ্যের মধ্যে সাজানো-গোছানো আশ্রয়স্থল হারিয়ে যেন বাকরুদ্ধ তারা। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে কি করবেন এমন দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাদের মনে। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটের দিকে মিরপুরের চলন্তিকা মোড় সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে ২৪টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় রাত ১০.৩০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। তবে রাত ১.৩০ মিনিটের দিকে আগুন পুরোপুরি নির্বাপন করা সম্ভব হয়। আগুনের ভয়াবহ তীব্রতায় ঝিলপাড় বস্তি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কাঁচা টিনের ঘরগুলো এবং ঘরের সব সরঞ্জাম। আর এই ধ্বংসস্তূপে সব হারানো মানুষগুলো খুঁজে ফিরছেন অবশিষ্ট সম্বল। পোড়া ছাইয়ের নিচ থেকে নেড়ে-চেড়ে লোহার \হআসবাবের ফ্রেমগুলো বের করছিলেন তারা। পেশায় সুইপার আলমগীর নিজের পুড়ে যাওয়া ঘর থেকে অবশিষ্ট আসবাব টেনে তুলছিলেন আর কিছুক্ষণ পরপর চোখ মুছছিলেন। কারো সঙ্গে কথা বলতে গেলেই চিৎকার করে উঠছেন স্বপ্ন পুড়ে যাওয়া মানুষটি। তিনি জানান, তার ১৩টা ঘর ছিল বস্তিতে। সেখানে স্ত্রী-পুত্র, ছেলের স্ত্রী, নাতিদের নিয়ে বসবাস করছিলেন। ১৩ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করা আলমগীরের এই বস্তিতে অস্থায়ী ঠিকানা প্রায় ৩০ বছরের। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে। তিনি বলেন, 'আমরা সবাই বাঁইচা আছি বাবা, তয় না বাঁচার মতো। আগুন লাগার পর সবাই সুস্থভাবে কোনোমতে জানডা নিয়া বাইর হইয়া আইছি। লগে কিছু আনতে পারি নাই। আমার সবকিছু শেষ হইয়া গেল, দেহেন বাবা সব ছাই হইয়া গেছে।' দীর্ঘদিনের আবাস এই বস্তির সংসারে তিলে তিলে খাট, টিভি-ফ্রিজ, আলমারিসহ বিভিন্ন আসবাব জুড়িয়েছিলেন তিনি। যার সবকিছুই প্রায় ছাই হয়ে গেছে। শুক্রবার রাত থেকে না খেয়ে থাকা আলমগীর বলেন, 'আইজও দুপুর হইতে লাগল এহনো কিছু খাইতে পারি নাই। কিছু কিন্না খাওনের মতো কাছে একটা টাকাও নাই। এহন আমরা কই যামু, কই থাকমু, কেমনে খামু?' এসব বলতেই আবার কেঁদে ওঠেন তিনি। অটোরিকশাচালক তৈয়ব বলেন, 'উত্তর দিকে যখন আগুন লাগে মানুষ সব দৌঁড়াদৌঁড়ি কইরা বাইর হইছে। এর মইধ্যে কোনোমতে এক কাপড়ে বউ-ছেলে নিয়া বাইর হইছি। কিছু লগে নিতে পারি নাই।' আকলিমা নামের গার্মেন্টকর্মী ধ্বংসস্তূপ থেকে পুড়ে যাওয়া অবশিষ্ট আসবাব ভ্যানে করে বের করছিলেন। তিনি জানান, ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি ভোলা ছিলেন তিনি। বস্তিতে আগুন লাগার খবর পেয়ে রাতেই রওনা দিয়ে আসেন। এসে তার ঘরের আর কিছুই অবশিষ্ট পাননি। ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুনে প্রায় ৫০০-৬০০ ঘর পুড়ে গেছে, আর এতে প্রায় তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনের উৎস নিশ্চিত করতে এরইমধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নরসিংদীর মনোহরদী থেকে এসেছেন সুমাইয়া (২৫)। বলেন, ঈদের ছুটিতে স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। তিনি গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার স্বামী একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। বস্তির সাত নম্বর রোডের নয় নম্বর গলিতে তার ঘর ছিল। আগুন লাগার খবর রাতে শুনেই স্বামীকে নিয়ে ভোরে এসে পৌঁছেছেন। পৌঁছেই ঘরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যাবেন কোথায়? কোথাও ঘর বলে কিছু নেই। সব সমান হয়ে গেছে। তিনি ঈদের আগে কাপড়চোপড়সহ যেসব জিনিস সঙ্গে নিয়ে গেছেন, তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন কোথায় থাকবেন, তা জানেন না। তাদের স্কুলে থাকতে দেয়া হবে বলে শুনেছেন। কিন্তু এখনো কেউ কোথাও যায়নি। এখনো সবাই বস্তির আশপাশেই আহাজারি করছে। বস্তির বাসিন্দা শামীম হাসান বলেন, 'আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। সকাল থেকে ঘর খোঁজার চেষ্টা করেছি। ঈদে বউ আর বাচ্চা জামালপুরে বাড়ি গেছে। আগুন লাগার কথা শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছি। কিছু সঙ্গে আনতে পারিনি।' বস্তির পাশেই দুই নম্বর রোডের বাসিন্দা দিলদার আহমেদ বলেন, আগুন দেখে তারা ভয় পেয়েছিলেন। আগুন দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ছিল। বস্তির পাশাপাশি মসজিদসহ আশপাশের চারটি বাড়িতে ওই আগুন ছড়াতে দেখেন তিনি। স্থানীয় অনেক লোক বলছেন, মিরপুর ৭ নম্বরের বস্তিটি অবৈধ। এখানে বেশির ভাগ বাড়ি টিন ও কাঠের। একেকটি বাড়ি টিন দিয়েই তিন-চারতলা করা হয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি করা এসব ঘরের কারণে আগুন দ্রম্নত ছড়িয়েছে। বস্তির আশপাশের বাড়িগুলোতেও আগুন নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়। স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল বাশার বলেন, বস্তির পাশেই তাদের বাসা। তারা আগুন ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ছিলেন। দ্রম্নত বাড়ি ছেড়ে সবাই বাইরে চলে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আগুন নেভানো সম্ভব হওয়ায় তারা রক্ষা পেয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিট কাজ করেছে। র?্যাব, পুলিশ, ওয়াসা ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মী জাহিদ হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে। পরে তদন্ত করে বিস্তারিত বলা যাবে। আগুনের খবর পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্যা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। তারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সহায়তার আশ্বাস দেন। সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্যা বলেন, ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক বস্তিতে থাকত। সবাই ঈদে বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসে কেউ কিছু পায়নি। এখানে যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। পুলিশ সূত্র বলছে, এ ঘটনায় চারজন আহত হয়েছে। তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কেউ নিখোঁজ নেই।