প্রত্যাবাসন নিয়ে অস্থিতিশীলতার শঙ্কা

রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত কিছু দেশি-বিদেশি এনজিও উসকানিমূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সতর্ক থাকার পরামর্শ গোয়েন্দাদের

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
সব রকম প্রস্তুতি থাকলেও বৃহস্পতিবার এভাবেই ফাঁকা পড়েছিল রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্প -যাযাদি
রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছে গোয়েন্দারা। এ পরিস্থিতির জন্য ক্যাম্পে নিয়োজিত বেশকিছু এনজিওকে দায়ী করছেন তারা। গোয়েন্দাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে কিছু দেশি-বিদেশি এনজিও উসকানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে ফিরে না যায় সে জন্য তাদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে। কেননা এতে তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটবে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ক্যাম্পগুলোতে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি যেসব এনজিও উসকানিমূলক তৎপরতায় যুক্ত রয়েছে তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছে তারা। এদিকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গ্রম্নপ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে স্থানীয়রা। তারা জানান, এ চক্র শিবিরে শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। স্বদেশে যেতে আগ্রহী কেউ কেউ এর আগে খুন হয়েছেন- এ বিষয়টি তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। প্রত্যাবাসন ইসু্যতে তারা নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ছক কষছে বলেও অনুমান করছেন স্থানীয়রা। গোয়েন্দা সংস্থা ও কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের অনুমান-আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা স্বীকার করেছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, এর আগে ২০১৮ সালের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে নানা কৌশলে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। ওই সময় সেখানে রোহিঙ্গার হাতে রোহিঙ্গা খুন, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং ক্যাম্পে বিক্ষোভসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ তৎপরতার সৃষ্টি হয়। ক্যাম্পে নিয়োজিত কিছু এনজিওর বিরুদ্ধেও অস্থিতিশীলতায় উসকানি দেয়ার প্রমাণ মিলে। এবারও সেই পুরান কৌশলেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে বলে মনে করেন তারা। এদিকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পন্ড করার একটি চক্র তৎপর বলে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও অভিযোগ তুলেছেন। তিনি ওই গোষ্ঠীকে এ ধরনের অপতৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি তাদের কঠোরভাবে হুশিয়ারও করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, 'রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য অনেকেই প্ররোচণা চালাচ্ছেন। লিফলেট বিতরণ করছেন। ইংরেজিতে পস্ন্যাকার্ড লিখে দিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।' কক্সবাজার জেলার ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, একটা গ্রম্নপ প্রত্যাবাসন বিষয়টিকে অন্যদিকে মোড় দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে। এজন্য তাদের ভুল বোঝানো হচ্ছে। তবে এ নিয়ে যাতে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে পুলিশ ও গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে। অন্যদিকে কক্সবাজার প্রশাসন সূত্র জানায়, প্রত্যাবাসন ইসু্যতে রোহিঙ্গারা যাতে কোনো ধরনের বিক্ষোভে নেমে সেখানকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে না পারে সে ব্যাপারে তারা সতর্ক রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, স্বার্থনেষী কিছু এনজিও অনেক দিন আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় এর আগে তারা উখিয়ায় পাহাড় কেটে নতুন করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প তৈরি করেছে। এতে বিশাল বনভূমি উজাড় হয়েছে। ওই চক্র এখন প্রত্যাবাসন ইসু্যতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করতে চাইছে। স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি অভিযোগের সুরে বলেন, বেশকিছু এনজিও নিজেদের আখের গোছাতে এর আগে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে অনাগ্রহ তৈরির অপচেষ্টা চালিয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমারে ফিরে না যায়। রোহিঙ্গা ইসু্য নিয়ে এসব এনজিও দীর্ঘ সময় দাতা সংস্থার অর্থ লুটপাট অব্যাহত রাখতেই বেশি তৎপর বলে মন্তব্য করেন তারা। এদিকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পন্ড করতে রোহিঙ্গাদের একাধিক সন্ত্রাসী গ্রম্নপ সক্রিয় থাকার তথ্য দিয়েছে স্থানীয়রা। তারা জানান, এ চক্র বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের দিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য পাচার করে আসছে। এ কাজে তারা নারী ও শিশুদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ অবস্থায় শরণার্থী রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে গেলে তাদের সে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভন্ডুল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর এ জন্য তারা নানাভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গোপনে কাজ করছে। তারা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি দালাল গ্রম্নপ তৈরি করে দিয়েছে। ওই চক্রটি প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা কেউ মিয়ানমারে ফিরতে তাকে হত্যা করা হবে এমন ভয়ও দেখাচ্ছে। এ চক্রকে দ্রম্নত চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে করেন ওই জনপ্রতিনিধিরা। এদিকে কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম জানান, গত মঙ্গলবার ও বুধবার সাক্ষাৎকার নেয়া ২৯৫ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে ১ জন শরণার্থীও প্রত্যাবাসনে রাজি না হওয়ায় বৃহস্পতিবার পূর্বনির্ধারিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মূলত স্থগিত করা হয়েছে। তবে সাক্ষাৎকার গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ কিনা জানতে চাইলে আবুল কালাম বলেন, 'এটা ব্যর্থ বলতে পারেন না। সব পরিবারের সাক্ষাৎকার চলবে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে এটা। আমাদের বাস-ট্রাকও রেডি থাকবে। কেউ যেতে চাইলে পাঠানো হবে।' মিয়ানমারে ফিরতে যেসব শর্ত দিয়েছেন রোহিঙ্গারা সেসব শর্তের ব্যাপারে তিনি বলেন, 'এগুলো মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাদের ব্যাপার। আমরা শুধু সীমান্ত পার করে দেব।' তিনি আরও জানান, 'মিয়ানমার সরকারের দেয়া ছাড়পত্র অনুযায়ী এক হাজার ৩৭টি পরিবারের মোট তিন হাজার ৫৪০ জনকে ফেরত নেয়ার প্রথম তালিকাটি দেয়া হয়েছে। আমরা সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে অন্যদের এই প্রক্রিয়ায় আনা হবে। কারণ এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।' এদিকে উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এটি সম্পূর্ণ একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের এভাবে ফেরত নেয়া যাবে না, তা সবারই আগে থেকেই জানা। খুব সম্ভবত আমরা এখন মিয়ানমারকেই বাঁচিয়ে দিতে নাটকের কর্মী হিসাবে কাজ করছি। এখন দ্বিতীয়বার প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েও রোহিঙ্গাদের ফেরাতে না পারার দায়ে উল্টো মিয়ানমার আমাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে কিনা সেটা এখন দেখার বিষয়।' তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যবাসন করলেই এ প্রক্রিয়া সফল হবে বলে মত দেন তিনি। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে রোহিঙ্গারা নেতারা টেকনাফের নয়াবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক সংবাদ সম্মেলন করে মিয়ানমারে ফিরতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও নাগরিকত্বসহ চারটি শর্তের কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ উলস্নাহ বলেন, মিয়ানমারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নাগরিকত্ব দেয়া, জমিজমা ও ভিটেমাটির দখল এবং সে দেশে ক্যাম্পে যে এক লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখা হয়েছে তাদের বাসস্থান ফিরিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, 'কোন আপস ছাড়া এই চার শর্ত মানলে আমরা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাবো। আমরা সবসময়ই চলে যাওয়ার জন্য রাজি আছি। তবে সব কথার শেষ কথা, শর্ত না মানলে আমরা কিছুতেই যাব না। যেতে চাইব না। জোর করে কেউ আমাদের ফিরিয়ে নিতে পারবে না।' সৈয়দ উলস্নাহ দাবি করেন, তিনি ৯০ ভাগ রোহিঙ্গার দাবি উপস্থাপন করেছেন। এ সময় চারটি ক্যাম্পের দলনেতা, ইমাম ও সোসাইটির সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও ক্যাম্পের চেয়ারম্যানরা কেউ ছিলেন না। এদিকে দুই বছর আগে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কেউ মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি না হওয়াকে 'দুঃখজনক' বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। একদফা পেছানোর পর বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও দুপুর পর্যন্ত কেউ ফিরতে রাজি না হওয়ায় বিকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে এ প্রতিক্রিয়া জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সরকার চেয়েছে বৃহস্পতিবার থেকেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হোক। কিন্তু রোহিঙ্গারা যে যেতে চাচ্ছে না- 'এটা দুঃখজনক। এটা আমরা প্রত্যাশা করি না'। প্রত্যাবাসন শুরু না হলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এরপরও আমরা প্রক্রিয়াটা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করব। আমরা জোর করে কিছু করব না। আস্থার যে ঘাটতি আছে সেটা দূর করতে মিয়ানমারকেই কাজ করতে হবে।' মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সংবলিত পস্ন্যাকার্ড প্রদর্শন ও লিফলেট বিলির প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, 'কারা পস্ন্যাকার্ড বা লিফলেট করে দিচ্ছে, তাদের আমরা চিহ্নিত করছি। তারা বিভিন্ন ডিমান্ড করছে। তাদের ডিমান্ডের কাছে আমরা জিম্মি হতে পারি না।'