অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই

প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি, বাম আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বর্ষীয়ান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই। রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ৪৯ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিলস্নাহি... রাজিউন)। এর আগে, গত ১৪ আগস্ট অধ্যাপক মোজাফফরকে ঠান্ডা লেগে বুকে কফ জমে যাওয়া এবং ব্যাকবোনে ব্যথা শুরু হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ক্রমেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকায় সোমবার তাকে আইসিইউতে নেন চিকিৎসকরা। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশসহ বাম ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতিতে কিংবদন্তিতুল্য মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিলস্নার দেবিদ্বারের এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজেকে তিনি সব সময় 'কুঁড়েঘরের মোজাফফর' বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। তিনি শিক্ষা জীবনের কৃতী শিক্ষার্থী কর্মজীবনে অধ্যাপনার পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকা কলেজ এবং তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়িয়েছেন। রাজনীতি অবিরত রাখবার প্রয়োজনে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি প্রার্থীও ছিলেন। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুর জেলায় অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর চীনপন্থি ও মস্কোপন্থি- এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থি ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থি ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। মস্কো শিবিরে পূর্ব পাকিস্তানপন্থি ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত ছিল। রাজনীতি অঙ্গনে তার শুভসূচনা হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ জেলা কুমিলস্নার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন রাজনীতির ময়দানের সবাইকে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ- এর প্রতিনিধি নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন। দীর্ঘ আট বছর সময়ব্যাপী আত্মগোপনে থাকবার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কারাবরণও করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। উপদেষ্টা কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন। সে সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নিজস্ব উনিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে অধ্যাপক আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। স্বাধীন বাংলার রাজনীতিতে পদচারণা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলে তিনি ন্যাপ, সিপিবি এবং প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আহমদ কারারুদ্ধ হন। রাজনীতি জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের নানান দেশে সফর করেন। তার সহধর্মিণী আমিনা আহমদ বর্তমানে ন্যাপের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং সভানেত্রী হিসেবে আছেন বাংলাদেশ নারী সমিতিতে। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের একজন মহিলা সংসদ সদস্য তিনি। বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে স্বাধীনতা পদক দেয়ার ঘোষণা দিলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, রাজনীতির অর্থ দেশ এবং মানুষের সেবা। পদ বা পদবির জন্য কখনো রাজনীতি করেননি তিনি। পদক দিলে বা নিলেই যে মানুষ সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বিশ্বাসী নন। ঘটনাবহুল বিশ্বব্যবস্থায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক দর্শন, চিন্তাধারা ও দূরদর্শিতা বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী বলে শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও প্রমাণিত হয়েছে। দেশপ্রেমে জাগ্রত রাজনৈতিক কর্মী সৃষ্টির প্রয়াসে মদনপুরে তার প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের একমাত্র শিক্ষায়তন 'সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ'। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে প্রায় নিষ্ক্রিয় এবং বিভক্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) একাংশের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর নিজেকে 'কুঁড়েঘরের মোজাফফর' বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। বাংলাদেশের প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবাদপ্রতিম এ ব্যক্তিত্ব নিজেকে সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবেসেছেন আজীবন। অধ্যাপক আহমদ ব্যক্তিজীবনে কথাবার্তা বলেন কিছুটা কৌতুকমিশ্রিতভাবে; কখনো থাকে প্রচ্ছন্ন হেঁয়ালির ছোঁয়া। তিনি কাছের মানুষদের কাছে একসময় বলতেন, 'আমার নাম মোজাফফর আহমদে নূরী, আমি পথে পথে ঘুরি।'