কর্ণফুলীর বুকে ফোঁড় কাটছে বঙ্গবন্ধু টানেল

প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
এগিয়ে চলছে টানেলের কাজ
যেখানে দিন নেই, সেখানে রাতের পার্থক্যও নেই। ঠিক তেমন-ই এক জগতের সৃষ্টি হয়েছে কর্ণফুলীর তলদেশে। স্রোতস্বিনীর বুকে এখন রাজ্যের ব্যস্ততা। ঘুচে গেছে দিন-রাতের পার্থক্য। গত ছয় মাসের খনন শেষে কর্ণফুলীর তলদেশে পৌঁছে গেছে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম)। প্রতি মুহূর্তে ফোঁড় কাটছে কর্ণফুলীর বুকে। ওই গভীরে কী কর্মযজ্ঞ চলছে তা কি আঁচ করতে পারছেন কর্ণফুলীর হাজার বছরের সঙ্গী সাম্পানওয়ালা, জেলে আর মাঝি-মালস্নারা? চলতি বছরের ২৪ ফেব্রম্নয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খননকাজ উদ্বোধনের পর গত ছয় মাসে বঙ্গবন্ধু টানেল (কর্ণফুলী টানেল) এগিয়েছে ৩৬০ মিটার। যা মূল টানেলের খননকাজের ১৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, ভৌত অবকাঠামোসহ প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে টানেল প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, 'এখন পর্যন্ত টানেলের ৩৬০ মিটার অংশের খননকাজ শেষ হয়েছে। টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার বা ৩ হাজার ৪০০ মিটার। এর মধ্যে টিউবের দৈর্ঘ্য হবে ২ হাজার ৪৫০ মিটার।' কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে চলছে খননের মূল কাজ। প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু দৈত্যাকৃতির এ টিবিএম কর্ণফুলীর পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে মাটি কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে আনোয়ারা পয়েন্টের দিকে। টানেল বোরিং মেশিনটি কোনো কোনো পয়েন্টে নদীর তলদেশের মাটি থেকেও ১৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত পাতালে ঢুকবে, যার মধ্য দিয়ে তৈরি হবে সুড়ঙ্গ পথ। মেশিনটি নদীর উত্তরপ্রান্ত থেকে পথ কাটা শুরু করেছে, বের হবে দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত ভৌত অবকাঠামো তৈরিসহ প্রকল্পের মোট ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। গত ছয় মাসে মোট কাজ এগিয়েছে ১৪ শতাংশ। এর আগে সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, ফেব্রম্নয়ারিতে টানেলের খননকাজ শুরুর আগেই তারা প্রকল্পের প্রায় ৩২ শতাংশ কাজ শেষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরীর দাবি, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) প্রকল্প মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারবে। কাজের অগ্রগতি নিয়ে হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, 'মোট কাজের ৪৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। সোমবার (১৯ আগস্ট) পর্যন্ত ৩৬০ মিটার অংশে মোট ১৮০টি রিং বসানো হয়েছে। প্রতি আটটি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন এভাবে ৪ থেকে ৫ মিটার করে টানেল তৈরির কাজ এগোচ্ছে।' তিনি আরও বলেন, 'এখন টিবিএম মেশিনটি টিউব তৈরি করে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা অংশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা দুই লেনের একটি টিউব সড়ক হবে। সেটি শেষ হলে টিবিএম আনোয়ারা প্রান্ত থেকে নদীর তলদেশে ঢুকে আরেকটি দুই লেনের সড়ক খোদাই করে পতেঙ্গা অংশে বের হবে। এভাবে দুটি টিউবে চার লেনের সড়ক পথ হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে।' প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলীর পশ্চিম ও পূর্বপ্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজও তৈরি করা হবে। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল নির্মাণের পাশাপাশি টানেলের পূর্ব (আনোয়ারা) প্রান্তে ওপেন কাট ২০০ মিটার, কাট অ্যান্ড কভারের ১৯৫ মিটার, অ্যাপ্রোচ রোড ৫৫০ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণ করা হবে। অন্যদিকে, টানেলের পশ্চিম (পতেঙ্গা) প্রান্তে ওপেন কাট ১৯০ মিটার, কাট অ্যান্ড কভারের ২৩০ মিটার, অ্যাপ্রোচ রোড চার হাজার ৭৯৮ দশমিক ৯৫ মিটার এবং ২৫ মিটার ওয়ার্কিং শ্যাফট নির্মাণ করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের জন্য ৩৮১ একর জমির মধ্যে বেশিরভাগ জায়গা অধিগ্রহণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। উলেস্নখ্য, টানেল নির্মাণে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিসি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পসহ মোট ছয়টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন। টানেল নির্মাণে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় সিসিসিসি। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় আট হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এরই মধ্যে চীন অর্থায়ন করছে প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে। ২০২২ সাল নাগাদ টানেল নির্মাণ শেষে হলে কর্নফুলীর তলদেশ দিয়ে শুরু হবে গাড়ি চলাচল। বিশ্ব দেখবে সাংহাইয়ের আদলে 'ওয়ান সিটি টু টাউন' মডেলের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।