বিশ্বমন্দার কালো ছায়া পড়ার শঙ্কা

ঝুঁকি সামলাতে প্রস্তুতি কতটা

পোশাক, আমদানি ও রপ্তানি, আইটি, মানবসম্পদসহ বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বৈশ্বিকভাবে অর্থনীতির সম্পৃক্ততা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সতর্ক থাকার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, দেশীয় অর্থবাজারে ক্রমবর্ধমান শ্রেণিকৃত ঋণের হার এবং কিছুটা সংকুচিত উদ্বৃত্ত তারল্য পরিস্থিতি প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতির ধারাকে ব্যাহত করতে পারে

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রবল ঢেউ ক্রমেই চারদিকে ধেয়ে আসছে। এরই মধ্যে ভারতের অর্থনীতি বেশ খানিকটা মন্দ অবস্থানের দিকে এগিয়েছে। চীনের অর্থনীতি চাপের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ধীরগতি এবং যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিট ইসু্য নিয়ে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে সেখানকার অর্থনীতিতে এরই মধ্যে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকাশেও এর কালো ছায়া পড়ার জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা সামাল দেয়া কতটা সম্ভব হবে এবং এ ব্যাপারে সরকারের আগাম প্রস্তুতি কতটা তা এখন অর্থনৈতিক অঙ্গনে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী যে মন্দা দেখা দেয়, তার প্রভাব তখন বাংলাদেশের ওপর সেভাবে পড়েনি। তবে গত ১০ বছরে দেশের অর্থনীতির সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ সময়ে পোশাক আমদানি-রপ্তানি, আইটি ও মানবসম্পদ খাতসহ নানা নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়েছে। এ অবস্থায় বিশ্ব অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা তৈরি হলে তার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়বে। বিশেষ করে ব্রেক্সিট ইসু্য নিয়ে ইউরোপিয়ন ইউনিয়নে প্রকট সমস্যা সৃষ্টি হলে দেশের পোশাক খাতে প্রভাব পড়বে। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার প্রভাব বাংলাদেশে না পড়ায় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের আত্মতৃপ্তি রয়েছে। তাই এর কালো ছায়া বাংলাদেশের অর্থনীতির আকাশ ঢাকলে তা সামাল দেয়া বেশখানিকটা কঠিন হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সারা বিশ্বের অর্থনীতি আগমী দিনে খুব দুর্বল হয়ে যাবে তা বোঝা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চায়নার বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। এর মধ্যে ব্রেক্সিট একটি বড় সমস্য। তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে আছে। তবে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব পড়বে কি পড়বে না সেটা নির্ভর করছে মন্দা মোকাবিলায় কী ধরনের পলিসি গ্রহণ করা হবে। এজন্য এখন থেকেই দীর্ঘ মেয়াদি নীতি-সহায়তা সরকারকে নিতে হবে। কোনোভাবেই দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের চাহিদা কমানো যাবে না। তার জন্য (২০০৭-০৮ ) সালের অজ্ঞিতা কাজে লাগানো যেতে পারে। ওই সময় রপ্তানির জন্য আলাদা নগদ সহয়তা ও সবুজ শিল্পের জন্য আলাদা তহবিল তৈরি করা হয়েছে। রপ্তানি তহবিলের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে আসন্ন মন্দা মোকাবিলায় একই ধরনের পলিসি আরও শক্তিশালী করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। সাবেক এ বাংলাদেশ ব্যাংকপ্রধান বলেন, মন্দা মোকাবিলার বড় অস্ত্র হলো রপ্তানি, কৃষি, ছোট ও মাঝারি খাতের দিকে জোর দেয়া। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মনে রাখতে হবে এবারের মন্দা যদি মোকাবিলা করতে হয় তাহলে অভ্যন্তরীণ ঋণের চাহিদা বাড়িয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে রপ্তানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। চলতি অর্থবছরে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকা যদি শ্লোডাউন হয়ে যায় তাহলে এ রপ্তানির টার্গেটের ওপর কিন্তু প্রভাব পড়বে। সুতরাং এখন থেকে রপ্তানির নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। জাপান, চায়না, ইন্ডিয়া ও অষ্ট্রেলিয়াতে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। এসব নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ানো হবে মন্দা মোকাবিলার সবচেয়ে বড় কৌশল। এদিকে দেশের অর্থনীতিও এখন চাপের মধ্যে আছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধিও অর্থনীতির দুর্বলতা ঢাকতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ২১ জুলাই দেশের সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরি পলিসি বিভাগ ও চিফ ইকোনমিস্ট ইউনিট থেকে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা প্রতিবেদন উপস্থাপনা হয়। সেখানে অর্থনীতির স্বল্পমেয়াদি আভাস ও ঝুঁকি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, স্বল্প মেয়াদে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের পাশাপাশি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে প্রবৃদ্ধির উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, ইইউসহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য সংঘাতজনিত অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক সংকুচিত অর্থব্যবস্থা, বিলম্বিত ব্রেক্সিট পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় অর্থবাজারে ক্রমবর্ধমান শ্রেণিকৃত ঋণের হার এবং কিছুটা সংকুচিত উদ্ধৃত্ত তারল্য পরিস্থিতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতির ধারাকে ব্যাহত করতে পারে। সুতরাং অর্থনীতিতে নানা ঝুঁকি তৈরি হয়ে আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ কী করতে পারবে, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি বাজেট দিয়েছেন এবং উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে প্রকল্প অনুযায়ী তাদের কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করার নির্দেশ নিয়েছেন। এর মানে খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিশ্বমন্দার প্রভাব নিয়ে সচেতন আছেন। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী মন্দার প্রস্তুতির জন্য তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গত ১০ বছরে আমেরিকা, চায়না ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশে বাণিজ্য যেভাবে বেড়েছে তাতে বিশ্বমন্দার প্রস্তুতি আমাদের এখন থেকেই নিতে হবে। কারণ বিশ্বমন্দার বাতাস সবার গায়েই কিছু না কিছু লাগবে। এদিকে অর্থনৈতিক শ্লথতায় ভুগছে ভারতে অর্থনীতি। দেশটির ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবাহ কমেছে। দেখা দিয়েছে তারল্য সংকটও। স্বাধীনতার পর থেকে এমন দুরবস্থায় পড়েনি দেশটির অর্থনীতি। ভারতের অর্থনীতির বর্তমান নিন্মগতির কারণে দেশটির কাছের ও দুরের দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, সেখানে শুল্কারোপের মাধ্যমে দুটি দেশের উৎপাদন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এর ধাক্কা চীন নিলেও, পাল্টা হিসেবে দীর্ঘ মেয়াদে তা যুক্তরাষ্ট্রসহ এর ইউরোপীয় মিত্রদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে। উন্নত দেশগুলোর বাজার এভাবে আক্রান্ত হলে নিশ্চিতভাবেই এর প্রভাব এসে পড়বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর। বর্তমান বিশ্বকাঠামোয় একটি দেশকে অন্য দেশ থেকে আলাদা করা বেশ কঠিন। একইভাবে অর্থনীতির একটি সূচক অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ফলে কোনো একটি সূচকে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিলে তা খুব সহজেই অন্য সূচকগুলোকে আক্রান্ত করে। সেবা খাতে বিশ্বমন্দার কোনো প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর যায়যায়দিনকে বলেন, বিশ্বমন্দার প্রভাব সাধারণত সব খাতেই পড়ে। কিছু সেবা থাকে মানুষ তখন গ্রহণ করে না। কিছু দেশ কিছু সেবা আউটসোর্সিং করে। তখন তারা নিজেরাই ওই কাজটি করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দা মোকাবিলায় সব সময় শক্তিশালী একটি অবস্থানে থাকে যেমন ছিল ২০০৭-০৮ সালে। তবে আগের চেয়ে অর্থনীতির আকার এখন অনেক বড় হয়েছে। এ অবস্থায় মন্দার প্রভাব দেশের ওপর পড়বে। এদিকে ২৩ জুলাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্ব অর্থনীতির হালনাগাদ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বিশ্বমন্দার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, প্রাক্কলনের তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমবে। এ জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে বড় দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধকে। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ২ শতাংশ আর আগামী ২০২০ সালে হবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সংস্থাটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, আগামী বছর প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি কমবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে প্রবৃদ্ধির হার কমে হবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আইএমএফ বলছে, বিশ্বের আর্থিক বাজারও এখন যুদ্ধ করছে মূলত দুই শক্তির সঙ্গে। কেননা বাণিজ্যযুদ্ধ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্রমেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা মনে করছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব আরও বিরূপ হবে। এ ছাড়া, সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলায় দেশগুলো আর্থিক নীতিতে যেসব পরিবর্তন আনছে, তাতেও সংকট আরও জটিল হবে। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এক্সপোর্টার্স এসোশিয়েসন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী যায়যায়দিনকে বলেন, ২০০৭-০৮ সালের মন্দার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী এত সমাদৃত ছিল না। তবে ওই সময় মন্দা ছিল চ্যালেঞ্জিং এবং ঝুঁকিপূর্র্ণ। তবে সভাপতি হিসেবে তিনি রপ্তানি খাতের অবস্থা, শিল্পের অবস্থা এবং সক্ষমতা এ তিনটি বিষয় সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কারণে সরকার নীতি সহায়তা, নগদ প্রষোদনা, নতুন বাজার ও ছোট-মাঝারি খাতের জন্য প্রণোদনা দেয়। তাই সারা বিশ্বে মন্দা থাকলেও ওই বছরে দেশের রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৪ শতাংশ। যা এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। তবে বর্তমানে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা বিশ্বের অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। এর মধ্যে একটি হলো- প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে প্রাইস সক্ষমতা কমে যাওয়া। কারণ প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশের তুলনায় এ বিষয়ে অনেক বেশি নীতি সহায়তা পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। তাই মন্দা মেকাবিলায় রপ্তানি খাতের জন্য প্রাইস সক্ষমতার নীতি সহায়তা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। \হ