রংপুর-৩ আসন

এরশাদপুত্রকে সংসদে পাঠাতে আ'লীগের সঙ্গে সমঝোতা!

রংপুরে জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থান থাকলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরে না দাঁড়ালে হারের শঙ্কায় পড়তে পারেন সাদ এরশাদ। তাই সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে

প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
রওশন এরশাদ জিএম কাদের
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃতু্যতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে তার ছেলে রাহগীর আল মাহী সাদের (সাদ এরশাদ) পথ পরিষ্কার করতে জোটসঙ্গী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় পার্টি। তবে এখনো স্পষ্ট কিছু বলার সময় আসেনি জানিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর মনোয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়াম্যান জিএম কাদের। ইতোমধ্যে এ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। ভোটের হিসাবে সেখানে জাতীয় পার্টির শক্ত অবস্থান থাকলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরে না দাঁড়ালে হারের শঙ্কায় পড়তে পারেন সাদ এরশাদ। তাই এই সমঝোতার উদ্যোগ। সোমবার বনানীতে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, রংপুর-৩ আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। উত্তরে জিএম কাদের বলেন, 'এই মুহূর্তে আমরা বলতে পারছি না। হবে না এটাও বলতে পারছি না। এ বিষয়ে আমরা কথা বলার চেষ্টা করছি, আলাপ আলোচনা কিছুটা করেছি। আমরা এখনো কোনো ঐকমত্যে আসতে পারিনি। 'আমরা কিছু বিষয়ে আলোচনা করেছি, উনারাও বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত হয়তো আর দু-চার দিন পর প্রত্যাহারের দিনের মধ্যেই আমরা নিশ্চিত হব।' ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শফিকুল গণি স্বপন জেতার পর থেকে রংপুর আসনটি আর কখনো জাতীয় পার্টির হাতছাড়া হয়নি। সর্বশেষ দুটি নির্বাচনে এ আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ওই নির্বাচনে এরশাদের বিপরীতে কোনো প্রার্থী দেয়নি মহাজোটে তাদের শরিক আওয়ামী লীগ। চলমান একাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এরশাদ গত ১৪ জুলাই মারা গেলে রংপুর-৩ আসনটি শূন্য হয়। ৫ অক্টোবর ভোটের দিন রেখে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগ আভাস দিয়েছিল, এবার তারা আর রংপুরে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিতে চায় না। এরশাদের আসনে উপনির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজুর নাম ঘোষণা করা হয় গত শনিবার। এদিনে নানা নাটকীয়তার পর জাতীয় পার্টি গত রোববার জানায়, দলের প্রতিষ্ঠাতার আসনে তার ছেলে রাহগীর আল মাহী সাদকেই (সাদ এরশাদ) মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই উপনির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করা নিয়ে বিভেদ থেকে নেতৃত্বের কোন্দল তুঙ্গে ওঠায় জাতীয় পার্টি ভেঙে যাওয়ারও উপক্রম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ভাই জিএম কাদেরের মধ্যে দল ও সংসদে ক্ষমতা ভাগাভাগির রফায় আপাতত রক্ষা হয়। এরশাদের স্ত্রী ও দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এই আসনে ছেলে সাদকে প্রার্থী করতে চাইলেও তার বিরোধিতা করছিলেন রংপুরের নেতারা। এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফের সমর্থকরা সাদের কুশপুতুল পোড়ান। জাপার সাবেক সাংসদ আসিফ সোমবার জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। ফলে রাজনীতিতে নবিশ সাদকে এখন নিজের চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধেও লড়তে হবে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, 'আমরা যারা কমিটিতে ছিলাম, তারা বসে আলোচনা করেছি এবং তার বাইরেও কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে আমরা খোলামেলা আলোচনা করেছি। সার্বিক বিবেচনায়, সবকিছু হিসাব করে আমরা তাকে (সাদ) নমিনেশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করেন, দল যেহেতু মনোনয়ন দিয়েছে, নেতাকর্মীরা তার হয়েই কাজ করবেন। আসনটি জাতীয় পার্টির হাতেই থাকবে। রংপুর জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই আসনের প্রার্থিতা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে দলের জেলা ও মহানগর কমিটির মধ্যে। জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা উপনির্বাচনে সাদ এরশাদের পক্ষে রয়েছেন। অন্যদিকে সাদকে ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। 'বহিরাগত ও আনকোড়া' সাদকে সহযোগিতা করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু দেখছেন না দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, 'দলের অনেকের অনেক প্রত্যাশা থাকে। অনেকের অনেক রিঅ্যাকশনও থাকে। কেউ কেউ দল থেকে চলে যেতে চায়, কেউ কেউ দল ছেড়ে চলেও যায়। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় না। 'আমরা আশাবাদী যে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের প্রার্থীর পেছনে কাজ করবে এবং তাকে জয়ী করে আনবে।' এরশাদের মৃতু্যর পর দলের চেয়ারম্যানের পদ নেয়া জিএম কাদের সম্প্রতি বিরোধী দলীয় নেতার পদটি পাওয়ার জন্য স্পিকারকে চিঠি দিলে দলে বিভাজন মারাত্মক আকার পায়। এর পাল্টায় এরশাদের স্ত্রী রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে জাতীয় পার্টির একটি অংশ। শেষ পর্যন্ত শনিবার দুই পক্ষের নেতাদের সমঝোতা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জিএম কাদেরই পার্টির চেয়ারম্যান থাকবেন আপাতত। আর রওশন হবেন বিরোধী দলীয় নেতা। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, 'মতবিরোধ যে কোনো বড় উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারত। তাই দ্বন্দ্ব ঠেকাতে আমি একটা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি করেছিলাম। জ্যেষ্ঠ নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। শনিবার রাতের সমঝোতা বৈঠকে কারও পরাজয় হয়নি। দলের সকলের বিজয় হয়েছে।' ঐক্য ধরে রাখার প্রত্যাশার কথা জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, 'আমরা পরস্পরের ভাই হিসেবে ছিলাম, আমরা এখনো পরস্পরের ভাই আছি, সামনেও। 'আমাদের এই উদ্যোগের ফল খুব ভালো হয়েছে, অত্যন্ত শুভ হয়েছে এবং সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। আমরা সামনে যদি এটা ধরে রাখতে পারি, তাহলে আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের সামনে আর কোনো প্রতিবন্ধকতাকে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হবে না।' জাতীয় পার্টির ওই 'সমঝোতা' বৈঠকের আগে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা গণভবনে গিয়েছিলেন বলে পার্টির নেতাকর্মীরা জানালেও তা স্বীকার করেননি রাঙ্গা। এই সমঝোতায় আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকা ছিল কি না জানতে চাইলে জিএম কাদের বলেন, 'আমাদের দল আমরা চালাই, নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করি। সব প্রতিকূল অবস্থাতেই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। আমাদের কেউ পরিচালিত করছে, এটা ঠিক না।' সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদেরের সঙ্গে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সালমা ইসলাম, আদেলুর রহমান ও সোলায়মান শেঠ।