তালিকা হচ্ছে কিশোর গ্যাং ও তাদের গডফাদারদের

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
আটক কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য -ফাইল ছবি
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাং স্টারদের তালিকা না থাকায় তারা একের পর এক দুর্ধর্ষ অপরাধ করে নির্বিঘ্নে পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার কখনো এ চক্রের দু'চারজন গ্রেপ্তার হলেও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা গডফাদাররা স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে কিংবা রাজনৈতিক দাপট দেখিয়ে তাদের অনায়াসেই ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। এ সময় তারা অভিযুক্ত অপরাধীদের কাউকে দলীয় কর্মী, আবার কাউকে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে জাহির করছেন। পুলিশের হাতে তাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকায় স্থানীয় চাপে অনেক সময় তাদের তা মেনে নিতে হচ্ছে। এতে চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত ও ইন্ধনদাতারা অধরাই থেকে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে কিশোর অপরাধীদের পাশাপাশি তাদের গডফাদারদের সামাল দিতে ডাটাবেজ তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরির জোরাল উদ্যোগ নেয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মাঝপথে থমকে গেছে। এছাড়া সন্ত্রাসীদের তালিকায় বিরোধীদলীয় সাধারণ নেতাকর্মীর নামও নানা অপকৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে নির্ধারিত সময়ে এ তালিকা প্রকাশের পর তা নিয়ে উল্টো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলেছে। তাই এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে এবার কিশোর অপরাধীদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই নিরীহ কারও নাম যাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এতে অন্তর্ভুক্ত করা না হয় এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কেননা এর সঙ্গে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ জড়িত রয়েছে। পুলিশের এআইজি পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, কিশোর অপরাধী ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তালিকা গতানুগতিক পদ্ধতিতে হচ্ছে না। এবারের তালিকায় অপরাধীদের নাম-ঠিকানা-ছবি ছাড়াও তার পিসিআর (প্রিভিয়াস ক্রাইম রেকর্ড), শারীরিক বিশেষ চিহ্ন, মাদক নেশায় আসক্তি আছে কি না, থাকলে কোন ধরনের মাদক- এসব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করা হবে। তালিকাভুক্ত এসব কিশোর কোনো অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে তাৎক্ষণিক তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করে তা ওই সার্ভারে সংরক্ষণ করা হবে। একই সঙ্গে তার সংঘটিত অপরাধের বিষয়টিও লিপিবদ্ধ থাকবে। যা পরবর্তীতে দেশের প্রতিটি থানার পাশাপাশির্ যাব, এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ), ডিবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ), সিআইডি (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট), পিবিআই (পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য সংস্থা একই সার্ভারে ঢুকে নির্বিঘ্নে সার্চ করতে পারবে। এতে অপরাধীরা কেউ এলাকা বদল করে অন্য কোথাও নতুন গ্রম্নপ তৈরির চেষ্টা করলে তাদের সহজেই শনাক্ত করা যাবে। এদিকে নতুন ডাটাবেজ কিশোর অপরাধীদের তালিকায় তাদের অভিভাবকদের নাম-ঠিকানা, ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও টেলিফোন নম্বর এবং তাদের কর্মস্থলের বিবরণ লিপিবদ্ধ রাখা হবে। যাতে যে কোনো প্রয়োজনে তাদের মাধ্যমে এসব অপরাধীর অবস্থান দ্রম্নত নিশ্চিত হওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্কুল-কলেজের কোনো শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাংস্টার হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে তার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে লিখিতভাবে অবহিত করা হবে। যাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যাপারে বিশেষ নজরদারি অব্যাহত রাখে। পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, কিশোর অপরাধীদের নামের তালিকা তৈরি করে তাদের কারাগারে পাঠানো মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং তাদের সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই এর মূল টার্গেট। তাই তালিকাভুক্তির পাশাপাশি সন্তানদের ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন করাসহ বেশকিছু ভিন্নমুখী কার্যক্রমও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিশেষ করে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মাদকের ভয়াল থাবা এবং অপরাজনীতি থেকে দূরে রাখার ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ থাকবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারা যাতে শিশু-কিশোরদের মিছিল, সমাবেশ কিংবা পিকেটিংয়ের মতো কার্যক্রমে যুক্ত না করেন এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, কিশোররা ছোটখাটো অপরাধমূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নিজেরা সংগঠিত হলেও পরে ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক নেতারা তাদের দলে টেনে নেন। পরে তাদের দিয়ে রাজনৈতিক ব্যানারে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অপকর্ম করাতে শুরু করেন। কেউ কেউ তাদের দিয়ে মাদকদ্রব্য বেচাকেনা ও পাচারের মতো অপরাধমূলক কার্যক্রম করান। বিনিময়ে এসব কিশোরকে তারা নানাভাবে তাদের হিরোইজম (!) প্রকাশের সুযোগ করে দেন। এমনকি প্রয়োজনে তাদের হাতে শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিতেও দ্বিধা করেন না অনেকেই। তাই কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণের আগে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা গডফাদারদের চিহ্নিত করা জরুরি বলে মনে করেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর কর্মকর্তারা। এদিকে এ বিষয়টি সহমত পোষণ করলেও কিশোর গ্যাংস্টারদের সঙ্গে তাদের গডফাদারদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ কতটা কার্যকর করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেনর্ যাব-পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষস্থানীয় অনেকেই। তাদের ভাষ্য, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্তরিক হলে মাদকের গডফাদারদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। তবে রাজনৈতিক গডফাদারদের তালিকা তৈরি করা যথেষ্ট কঠিন হবে। এমনকি এ ক্ষেত্রে নানামুখী বাধা আসারও ব্যাপক শঙ্কা রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের স্বদিচ্ছা থাকলে এ প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তারা। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, কিশোর অপরাধীদের ডাটাবেজ তালিকা তৈরির লক্ষ্যে তারা তথ্য সংগ্রহের কাজ পুরোদমে শুরু করেছে। এরই মধ্যে রাজধানীর ১১৩টি কিশোর গ্যাংয়ের নাম তারা হাতে পেয়েছে। এদের মধ্যে কতগুলো গ্রম্নপ সরাসরি অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত তা যাচাই করা হচ্ছে। এছাড়া আরও কোনো কিশোর গ্যাং নতুন করে গড়ে উঠছে কি না তাও নিবিড়ভাবে খুঁজছে পুলিশ। এ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্বল্পসংখ্যক কিশোর গ্যাং সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও ভিন্ন কোনো অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িত নয়। তবে বিপুল সংখ্যক কিশোর গ্রম্নপ ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে নিয়মিত হাত পাকাচ্ছে। এরই মধ্যে তাদের ৪১টি স্বয়ক্রিয় গ্রম্নপকে গোয়েন্দারা চিহ্নিত করেছে। এসব গ্রম্নপের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা অন্তত দু'ডজন গডফাদারের তথ্যও গোয়েন্দাদের হস্তগত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এদিকে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, কিশোর অপরাধীরা শুধু ছিনতাই, চাঁদাবাজি কিংবা মারামারিই নয়, গ্যাংস্টার হওয়ার রোমাঞ্চে মেতে সিনেমার খলনায়কের মতো বাহাদুরি দেখাতে এদের একটি অংশ ধর্মীয় জঙ্গিবাদেও জড়াচ্ছে। হিরোইজমের ফাঁদে ফেলে দেশি-বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের দিয়ে বড় ধরনের নাশকতা ও হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর ছক তৈরি করছে। আবার কেউ কেউ ইন্টারনেট থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। তারা প্রযুক্তিতেও পারদর্শী হওয়ায় অপরাধ সংঘটনের আগে তা ধামাচাপা দেয়ার অনেক কৌশল তারা রপ্ত করে ফেলেছে। তাই তাদের চিহ্নিত করা গোয়েন্দাদের কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ চক্রকে শনাক্ত করে গতিবিধি সার্বক্ষণিক নজরে রাখা গেলে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা খানম মনে করেন, গ্যাং-কালচার মূলত মাদক, সন্ত্রাসবাদ ও রাজনৈতিক সংস্পর্শে প্রসার লাভ করে থাকে। কেননা আমাদের চলমান সিস্টেমটা সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় এসব অপরাধ পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এবং বেড়েই চলছে। অপরাধ বিশ্লেষক জিয়া রহমান বলেন, যে কোনো পরিবর্তনের ধারক-বাহক হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এ সংকট যদি এখনই কাটাতে না পারা যায়, পরে আরও বেশি সংঘবদ্ধ ও ভয়ঙ্কর হবে। ছোট থেকে বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাবে তরুণ প্রজন্ম। এর প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে একটি পলিসি থাকতে হবে। স্কুল পর্যায়ে 'সাইকোলজিস্ট' রাখা জরুরি। তাতে করে কিশোরদের মন বিক্ষিপ্ত হবে না; মন ও মানসিকতা অপরাধ থেকে দূরে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের শিক্ষক হাফিসুর রহমান বলেন, 'গ্যাং কালচারের মূল কারণ মানুষের ভেতরের বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব। জমি বিরোধ থেকে শুরু করে কেন সালাম দিল না, এমন যেকোনো কারণেই এ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।' তিনি আরও বলেন, 'সমাজে অপরাধের কিছু বিষয় মানুষের সহজাত। কিছু অপরাধ সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরকার বৈষম্য ও দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা। তাই এসব অপরাধের পেছনের কারণ নির্মূল করা গেলে এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যাবে।'