বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মপরিকল্পনার গোড়াতেই গলদ !

মাদকাসক্তি নিরাময়ে উলেস্নখযোগ্য পদক্ষেপ নেই সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে আগের মতো ঢিলেঢালা ভেস্তে যাচ্ছে মাদক পাচার রোধে নানা উদ্যোগ
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
আপডেট  : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:৪১
মাদক পাচার ঠেকাতে নানা কৌশলী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হলেও মাদকাসক্তি নিরাময়ে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়ে কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা (স্ট্যাটিজিক পস্ন্যান) ছক সাজালেও এর গোড়াতেই বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে। তাই কথিত ক্রসফায়ারে একের পর এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হলেও সারাদেশে মাদকের সরবরাহ ও খুচরা-পাইকারি বেচাকেনা আগের মতোই চলছে। মাদক ঠেকাতের্ যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নেয়া নানা কৌশল সহজেই ভেস্তে যাচ্ছে। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, গত বছরের মে থেকে শুরু হওয়া সাঁড়াশি অভিযানে দেশে মাদক পাচার অনেকাংশে কমেছে। যদিও তাদের এ দাবির সঙ্গে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের কোনো মিল নেই বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদক পাচার ঠেকাতে নানা কৌশলী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হলেও মাদকাসক্তি নিরাময়ে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে নতুন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র নির্মাণ, পুরান কেন্দ্রগুলোতে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো ও চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠলেও তাতে উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা নেই। বেশিরভাগ কেন্দ্রেই নেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সুযোগও নেই। বেসরকারি বেশির ভাগ কেন্দ্রেই মাদকের অন্ধকার জগতে থাকা ৯৯ ভাগ মাদকাসক্তই চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভাবে আলোর পথে ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন না। বরং বিপুলসংখ্যক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বেচাকেনার আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এতে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা না কমে বরং বাড়ছে। এছাড়া মাদকাসক্তদের বড় অংশই নিম্ন আয়ের হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা সবার পক্ষে বেসরকারিভাবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অথচ সারাদেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্তের বিপরীতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ৪টি এবং যশোর, রাজশাহী ও কুমিলস্না কারাগারে ৩টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার সরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের কেন্দ্রগুলোর অবস্থা অত্যন্ত বেহাল। তাই চরম বিপাকে না পড়লে কেউই তার মাদকাসক্ত স্বজনদের সেখানে ভর্তি করান না। অথচ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ৫০ শয্যার সরকারি মাদক নিরাময় হাসপাতাল এবং পর্যায়ক্রমে জেলা শহরে নিরাময় কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও সে ফাইল এখনো প্রশাসনের লাল ফিতাতেই বন্দি রয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক ব্যবসায় রোহিঙ্গা থেকে শুরু করে নানা পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী ও ছাত্র-ছাত্রীরা জড়িয়ে পড়েছে। সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানে অনেক সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত বা গ্রেপ্তার হয়েছে। অথচ আত্মসমর্পণ বা অভিযান অব্যাহত রাখার ঘটনার পরও ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক পাচার বা এর ব্যবসা প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি। এর কারণ মাদকবিরোধী অভিযান চললেও, এখনো মাদকে আসক্তদের এ পথ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে এর ব্যবসাও বন্ধ হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, 'অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী কোনো দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে দ্রব্যটির দাম বেড়ে যায়। আর দাম যদি বাড়ে তাহলে জোগানও বাড়ে। চাহিদা ও জোগানের এ সূত্র মাদকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই মাদক পাচার এবং এর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে এর চাহিদা কমাতে হবে। এজন্য আগে মাদকাসক্তের সংখ্যা কমাতে হবে। যা শুধুমাত্র সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা, মাদকাসক্তি নিরাময় এবং পরবর্তীতে তাদের পূনর্বাসনের মাধ্যমেই সম্ভব।' তাই এসব ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মাদকের চাহিদা এবং জোগান দুটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাদকের চাহিদা বন্ধ করা গেলে জোগান থাকলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ তখন কেউ মাদক কিনবে না।? তাই মাদকের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণভাবেও জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি বলে মত দেন তিনি। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের যথেষ্ট তাগিদ থাকলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। সরকারি পর্যায়ে মাদকসংক্রান্ত সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। গুটি কতক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা দেশের বিপুলসংখ্যক মাদকাসক্তের তুলনায় অতি নগণ্য। মাদকাসক্ত নিরাময়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা প্রখ্যাত চিকিৎসক আলী আশকার কোরেশী এ প্রসঙ্গে বলেন, মাদক নিয়ে পারিবারিক, সামাজিকভাবে সচেতনতার ব্যাপারে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। মাদক দ্রব্যের ভয়াবহতা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে তা এখনো অনেক অপ্রতুল। কারণ শহর এলাকা ছাড়িয়ে মাদক এখন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে। তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি শিশু-কিশোররা বিভিন্ন মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়েছে। অথচ যতটুকু প্রতিরোধমূলক কর্মকান্ড হচ্ছে, তা শুধুমাত্র বড় শহরগুলোতে হচ্ছে, তৃণমূল পর্যায়ে সেরকম কোনো প্রচারণা নেই। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে মাদক পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ সেখানেও মাদকাসক্ত ব্যক্তি রয়েছে। তাই মাদকের ব্যাপারে এখন দেশব্যাপী ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশের নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক অধ্যাপক এমদাদুল হক ২০১৮ সালে একটি গবেষণায় উলেস্নখ করেছেন, দেশটিতে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী। এছাড়া আছে ফেন্সিডিল, হেরোইন এবং অন্যান্য মাদক। এত দিন এ বিষয়টি খোলামেলাভাবে আলোচিত হয়নি, কিন্তু পরিস্থিতি সত্যি ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তদের নিয়ে পারিবারিক বা সামাজিকভাবে লুকোছাপার কারণে একদিকে যেমন আসক্তদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মাদকাসক্তি ঠেকাতেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত সচেতনতামূলক কার্যক্রমও শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। মাদকসেবীদের চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজে সম্পৃক্ত সামাজিক সংগঠনগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে গেলে তারা প্রশাসনিক সহযোগিতা তো পান-ই না, বরং উল্টো তাদের নানাভাবে হয়রানি হতে হয়। এছাড়া মাদকের গডফাদাররা সচেতনতামূলক কার্যক্রমে প্রকাশ্যে বাধা সৃষ্টি করেন। এমনকি এ কাজে সম্পৃক্তদের মারধর, ছুরিকাঘাত, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করারও বিস্তর নজির রয়েছে। দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে হলে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার, সরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো এবং বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রনে আরও অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে বলে মনে করেন তারা। বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্র্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, 'ভেতরে ভেতরে মাদক যে আগ্রাসন চালাচ্ছে, আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সেই সচেতনতা আমাদের ছিল না। তবে এ নিয়ে এখন প্রচারণামূলক কর্মকান্ড যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে।' এর সুফল শিগগিরই মিলবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে দেশে মাদক পাচারের রুট, এ বাণিজ্যের গডফাদার, মাদকাসক্তের সংখ্যা, তাদের নেশার ধরন ও মাদকের পেছনে অর্থব্যয়ের পরিমাণ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে পর্যালোচনা এবং গবেষণার কাজে সম্পৃক্ত সরকারি-বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যানুযায়ী, মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।?মাদকাসক্তরা মাদকদ্রব্য কেনায় বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। দেশে বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি। মাদকের ক্যারিয়ার বা খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা কয়েক লাখ।?কোনো কোনো মাদকসেবী আবার একই সঙ্গে খুচরা বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করেন।?মাদকবাণিজ্যের গডফাদারদের তালিকায় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই আছেন।? মাদকসেবীদের চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রধান তিনটি কারণে বাংলাদেশে মাদক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।?প্রথমত, চাহিদার সঙ্গে পর্যাপ্ত জোগান; দ্বিতীয়ত, মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত ও কৌতূহল; তৃতীয়ত, হিরোইজম।?মাদক সকল অপরাধের মূলে কাজ করে।? অধ্যাপক তাজুল ইসলামের ভাষ্য, মাদকের চাহিদা আছে, তাই সরবরাহও আছে।?আর এই সরবরাহ বন্ধ করতে না পারলে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না।?সরবরাহ বন্ধের দায়িত্ব সরকারের।?সরকার তার দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে সরবরাহ বন্ধ করতে পারছে না বা মাদক সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না।? বাকি দায়িত্ব সমাজ ও পরিবারের। যদি সরবরাহ বন্ধ করা না যায়, তাহলে সমাজ ও পরিবার দায়িত্ব পালন করলেও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই এর চাহিদা তৈরির জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তাই করবে।? মাদক পাচার ঠেকাতে নানা কৌশলী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হলেও মাদকাসক্তি নিরাময়ে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে নতুন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র নির্মাণ, পুরানো কেন্দ্রগুলোতে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো ও চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেই বললেই চলে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে