পুঁজিবাজারে আসলে হচ্ছেটা কী

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও বাজার অস্থির অর্থনীতির সব সূচক উঁচুতে আর পুঁ্‌জিবাজার নিচুতে গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে শতকরা ৮০ ভাগ বাজার মূলধন বাজার ওঠানামায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা নেই ঝুঁকিহীন বিনিয়োগের জন্য বন্ড মার্কেট চাঙা করার তাগিদ

প্রকাশ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আহমেদ তোফায়েল প্‌ুঁজিবাজারের ছোটো বিনিয়োগকারী আবু জাফর। ২০১০ সালে ৬৬ লাখ টাকা দিয়ে শেয়ারবাজারে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এখন তার বিনিয়োগ ছয় লাখ টাকায় নেমে এসেছে। দেশের অর্থনীতি যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন পুঁজিবাজার নেমে যাচ্ছে। তার প্রশ্ন, পুঁজিবাজার আর কবে ভালো হবে? আদৌ ভালো হবে কি? লাভ নয়, অন্তত তার বিনিয়োগকৃত টাকা ফিরে পাবেন কি না তারও কোনো জবাব নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কোনো মহলের কাছে। আবু জাফরের মতো দিশেহারা দেশের লাখ লাখ ছোটো বিনিয়োগকারী। তাদের প্রশ্ন, এ পতনের আসলে শেষ কোথায়? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে পুঁজিবাজারের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহলকে। খোদ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে যা কিছু করা দরকার এ সরকার তাই করবে। তারপরও কেন শেয়ারবাজারের এ বেহাল অবস্থা প্রশ্ন বিনিয়োগকারীদের। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক বাকী খলিলী যায়যায়দিনকে বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ ও অর্থমন্ত্রী বেশকিছু আশ্বাস দিয়েছেন। আসলে বাজার এ আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে না। বাজার ভালো করার ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক বিষয় বিবেচনা করা দরকার। প্রথম বিষয় হচ্ছে, একটি কোম্পানি ভালো পারফরম্যান্স করছে কি না। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে কি না। তৃতীয়ত, ম্যাক্রো অর্থনীতি ভালো আছে কি না। চতুর্থটি, মানি মার্কেট ও ক্যাপিটাল মার্কেটের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে কি না। শেয়ার কেনার আগে একজন বিনিয়োগকারীর এসব বিষয় বিবেচনা করা দরকার। তিনি আরও বলেন, সত্যিকার অর্থে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করতে চাইলে বাজারের পাশাপাশি বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন করতে হবে। ঝুঁকিহীন বিনিয়োগ করার জন্য বন্ড মার্কেটকে সক্রিয় করতে হবে। বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এদেশের চেয়ে খারাপ অর্থনীতির দেশের পুঁজিবাজারেও এ রকম অবস্থা দেখা যায় না। আইসিএবির কাউন্সিল মেম্বার মাহমুদ হোসেন বলেন, পুঁজিবাজারে সামান্য সমস্যা হলেও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করতে হয়। আবার জনগণের করের টাকায় লালিত-পালিত কর্মকর্তারা গাড়ি কিনে বিভিন্ন জায়গায় সভা করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বাজারের কোনো পরিবর্তন করতে পারছেন না। পুঁজিবাজারে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীরা লোকসান গুনছেন। এদিকে বাজারে ধারাবাহিক দরপতনের জন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট, কারসাজি, মানহীন কোম্পানির আইপিও, সুশাসনের ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্টদের দ্বন্দ্বকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাজারের বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে নেই। এর অংশ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ দাবিতে মতিঝিলে মানববন্ধনও করা হয়। সম্প্রতি বিএসইসির নির্দেশে আন্দোলনরত বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। এদিকে মূল্যসূচক ৩৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে। গত বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৫ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে ৪ হাজার ৯৩৩ দশমিক ১৭ পয়েন্টে। এই সূচক ৩৩ মাসের মধ্যে কম। এর আগে এরচেয়ে সূচক কম ছিল ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর। সেদিন সূচক ছিল ৪ হাজার ৯২৪ পয়েন্ট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিনিয়ত শেয়ারের দর, সূচক, টার্নওভার কমে যাচ্ছে। বিশ্বের অর্থনীতি উন্নয়নের উদাহরণ হতে যাচ্ছে দেশ। বাংলাদেশ এখন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারে গত দুই যুগে সিঙ্গাপুর ও হংকংকে ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে পুঁজিবাজারও বাড়ার কথা; কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য, বাজার ভালো করতে হলে বিনিয়োগকারীর চাহিদা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ভালো মানের ইকুইটি আনতে হবে। নড়বড়ে কোম্পানি দিয়ে বাজার ভালো করা যাবে না। পতনের মৌলিক কারণ নির্দিষ্টকরণ করতে হবে। শেয়ারবাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধসের জন্য মুষ্টিমেয় স্বার্থের প্রতাপ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহ বাজার মূলধনের বড় অংশীদার। তাদের বাড়া-কমায় বাজারের অগ্রগতি বা নিম্নগতি নির্ধারিত হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা শেয়ারবাজারে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোর মালিকানায় এমন ব্যক্তিদের থাকতে দেখা যায়, যারা আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে তিনি বা তারা একের পর এক অনিয়মের মাধ্যমে আর্থিক খাত অথবা শেয়ারবাজারে নৈরাজ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছেন। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ আমানতকারী, সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং লাভবান হন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগর অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, শেয়ারবাজারের পুরোটাই হলো গুটিকয়েক লোকের হাতে কুক্ষিগত। গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে শতকরা ৮০ ভাগ বাজার মূলধন রয়েছে। পুরো বাজারে তাদের পুঁজিই ৮০ ভাগ। বড় লেনদেনের ৮০ ভাগও করেন তারাই। এ জন্য তারা নিজেদের অনুকূলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আবার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থের পরিমাণ খুবই কম। এর কারণে তারা মুষ্টিমেয় লোকের কাছে জিম্মি। বাজারের ওঠানামায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। বারবার বিএসইসি থেকে বলা হয়েছে, যারা বাজারে দখলিস্বত্ব কায়েম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কমিটি করা হলেও কোনো ব্যবস্থা কখনোই নেয়া হয়নি। এবারও দুই হাজার বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে খোঁজখবরের কথা বলা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন এত বেশি জিডিপির দেশে পুঁজিবাজার এত ছোটো হবে কেন? পৃথিবীর সব পুঁজিবাজারেই সব ধরনের কোম্পানির তালিকাভুক্তির চেষ্টা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করা হয় না। করা হলে এটা সর্বজনের মুক্তবাজার হতে পারত। পরিণামে তথাকথিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে পুঁজিবাজারের আকারের মিল থাকত।