শুদ্ধি অভিযানের ঘোষণায় আওয়ামী লীগে কম্পন

'অনুপ্রবেশকারী' চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ ও সুবিধাবাদী চক্র চরম আতঙ্কে রয়েছে। এর সঙ্গে যেসব মন্ত্রী-এমপি জড়িয়ে রয়েছেন তারাও এখন 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' অবস্থানে।

প্রকাশ | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সোহেল হায়দার চৌধুরী
অপকর্মের দায়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে দেয়ার পরে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সর্বস্তরে শুদ্ধি অভিযানের কম্পন শুরু হয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে থাকা 'কাউয়া' ও 'হাইব্রিড' এবং 'অনুপ্রবেশকারী' চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ ও সুবিধাবাদী চক্র চরম আতঙ্কে রয়েছে। এর সঙ্গে যেসব মন্ত্রী-এমপি জড়িয়ে রয়েছেন তারাও এখন 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' অবস্থানে। কখন, কোন দিক দিয়ে অপকর্মের বজ্রপাতে কে পদ হারান, সুবিধাবাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা অনিয়মের সাম্রাজ্য 'তাসের ঘরের' মতো ভেঙে পড়ে সে আতঙ্কে ভুগছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতাদের একাংশ। এদিকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানা অপকর্মের হোতা যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ ভুঁইয়ার ক্যাসিনোতে বুধবারর্ যাবের অভিযানের পর তার সঙ্গী নেতারা পালানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটও যে কোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন। দলপ্রধান শেখ হাসিনার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি দলের সর্বস্তরে শুদ্ধি অভিযান আশা করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তৃণমূল নেতারা চাইছেন আসন্ন সম্মেলনে সতর্কতা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে 'কাউয়া' ও 'হাইব্রিড' মুক্ত করা হোক। তৃণমূল নেতাদের দীর্ঘদিনের এ দাবিকে দলপ্রধান আমলে নেয়ায় সংগঠনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের প্রাণে উচ্ছ্বাস জেগেছে। তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগে নতুন প্রাণস্পন্দন জাগবে শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় অনিয়ম ও অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ-টেন্ডারবাজদের দল থেকে বাদ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি যুবলীগের দুই বিতর্কিত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও খালিদ মাহমুদ ভুঁইয়ার নাম উদ্বেগের সঙ্গে উচ্চারণ করে বলেছেন, অনেকে মনস্টারে (দৈত্য) পরিণত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর রেশ কাটতে না কাটতে গত সোমবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।' তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'যারা অপকর্ম করে, অনিয়ম করে এ ধরনের নেতাকর্মী দলের ভেতরে না থাকাই ভালো। সরকার ও দলের ইমেজটা ক্লিন হওয়া দরকার। সেজন্য যা যা করণীয় সবই করা হবে।' শীর্ষ দুই নেতার এমন মনোভাব ও বক্তব্যে আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনে থাকা অপকর্মকারী হাইব্রিডদের মাঝে কম্পন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ওবায়দুল কাদের চিহ্নিত 'কাউয়া' ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম চিহ্নিত 'অনুপ্রবেশকারী'রা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন নেতার আশীর্বাদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তবে দলপ্রধান শেখ হাসিনার রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেক শীর্ষ নেতা এখন তাদের তৈরি সুবিধাবাদীদের এডিয়ে চলছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীরা চাইছেন দলের হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী ও গ্রপিং সৃষ্টি করে যারা আওয়ামী লীগসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোতে বিভেদ সৃষ্টি করছেন তাদের সরিয়ে দেয়া হোক। এর জন্য তারা কাউন্সিলকে সবচেয়ে মোক্ষম হিসেবে মনে করছেন। তৃণমূল নেতারা চান, দলের সর্বস্তর হাইব্রিড ও সুবিধাবাদী চক্র মুক্ত হোক। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে সরিয়ে দিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছেন তা ইতিহাসের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এর ফলে দলে থাকা হাইব্রিডদের মধ্যে নতুন আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালীভাবে তৈরি করতে হলে শুদ্ধি অভিযানের কোনো বিকল্প নেই। তার মতে, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিডরা এখন বেশি শক্তিশালী। তাদের জন্য ত্যাগী-পরীক্ষিত, দুর্দিন-দুঃসময়ে দলের জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করা নেতাকর্মীরা কোণঠাসা। তিনি জানান, তার নিজ এলাকায় তৃণমূলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে অবহেলা-অভিমানে সরে রয়েছেন। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে যায়যায়দিনকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় ও ঐতিহ্যবাহী একটি সংগঠনে নিয়মিত শুদ্ধি অভিযান চালানো দরকার। তার মতে, দলপ্রধান শেখ হাসিনা দলে অনিয়ম ও অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছেন তাতে তৃণমূল উজ্জীবিত। এর মাধ্যমে দলে লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদী অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের মূল্যায়ন ও মর্যাদা দানের মাধ্যমেই কেবল আওয়ামী লীগ এগিয়ে যেতে পারবে। অনুপ্রবেশকারী চক্রের মেরুদন্ড ভেঙে দিতে হবে আসন্ন সম্মেলনে। ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুলস্নাহ পনির যায়যায়দিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট সব সংগঠনে নিয়মিত শুদ্ধি অভিযান চালানো দরকার। তার মতে, দলের নেতৃত্ব বা পদে আসতে হলে পরীক্ষা নেয়া দরকার। যারা দীর্ঘদিন ধরে সংগঠন করে আসছে তাদের মূল্যায়ন না করে নতুন গজিয়ে ওঠা কাউকে দায়িত্ব দিলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার শুদ্ধি অভিযানের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আগামী কাউন্সিলে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের বাদ দিতে হবে। নতুবা দলে সংকট বাড়বে। কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মো. সদর উদ্দিন খান যায়যায়দিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতে শুদ্ধি অভিযান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াবে। তার মতে, আসন্ন কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতিবাজ, অপকর্মকারী, টেন্ডারবাজি-সন্ত্রাস ও অনিয়মকারীদের ঝাঁটিয়ে বিদায় করা দরকার। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা ও শেখ হাসিনার স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশ তৈরি করতে হলে কোনো ধরনের অপরাধীকে ছাড় দেয়া যাবে না। এজন্য যে কোনো ধরনের লড়াই করতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল প্রস্তুত বলে দাবি করেন এই নেতা। \হ