সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু

প্রবাসীদের সন্তানদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী স্কুল হচ্ছে

পর্যায়ক্রমে জর্ডান, লেবানন, ওমান, বাহরাইন, লিবিয়া, ইরাক, ব্রম্ননাইয়ে স্কুল স্থাপন করা হবে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা

প্রকাশ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের সন্তানের পড়ালেখার জন্য সেখানে স্থায়ী স্কুল নির্মাণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। প্রাথমিকভাবে সৌদি আরব ও বাহরাইন স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে জর্ডান, লেবানন, ওমান, বাহরাইন, লিবিয়া, ইরাক, ব্রম্ননাইয়ে স্কুল স্থাপন করা হবে। এসব দেশে স্কুল নির্মাণ করতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। সৌদি ও বাহরাইনের প্রস্তাবিত স্কুলগুলো সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল গত ১০ সেপ্টেম্বর দুই সপ্তাহের সফরে দুই দেশে গেছেন। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পরই দ্রম্নত সময়ে কাজ শুরু করা হবে। পুরো স্কুল নির্মাণের ব্যয় বহন করবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব সফরকালে সৌদি আরবে স্থাপিত বাংলা স্কুলগুলোর জন্য নিজস্ব জমি কিনে স্কুল স্থাপনের জন্য নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশে জমি পাওয়া গেলে সেখানেও স্কুল স্থাপন করতে বলেন তিনি। তারপর প্রাথমিকভাবে সৌদি আরব, বাহরাইনে স্কুল নির্মাণের জায়গা পাওয়া যায়। সৌদি আরবের দাম্মামে বাংলা স্কুলের জমি কেনা ও ভবন নির্মাণে দূতাবাসের চাহিদা অনুযায়ী ইতোমধ্যে ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাহরাইনে বোর্ডের অর্থায়নে স্কুল নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। সে লক্ষ্যে দেশ দুটিতে স্কুলগুলো জমি ও ভবন নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে প্রবাসী, পররাষ্ট্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চারজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ দুটি সফর করেছেন। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) গাজী মোহাম্মদ জুলহাস এ টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন। এছাড়াও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অধি-শাখার উপ-প্রধান শেখ মো. শরীফ উদ্দিন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক কাজী জিয়াউল হক এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আনোয়ারুল হক এ টিমে রয়েছেন। প্রতিনিধি দল সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা, দাম্মান, মদিনা এবং বাহরাইনে ৫টি স্কুল পরিদর্শন করবেন। এসব স্কুল নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সফরের ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিবেন। সেই প্রতিবেদনের আলোকে দ্রম্নত সময়ে অর্থ ছাড় ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অধি-শাখার উপ-প্রধান শেখ মো. শরীফ উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এসব স্কুল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ হলে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে এসব স্কুলে কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতিমধ্যে সৌদি আরব ও বাহরাইন স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। আর জর্ডান, লেবানন, বাহরাইন, লিবিয়া, ইরাক, ব্রম্ননাইয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৫০ কোটি টাকার চাহিদা পাওয়া গেছে। সৌদি আরবে তিনটি স্কুলের জন্য ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ছাড় হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ওমান, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হবে। এসব স্কুল স্থাপনের অর্থায়ন করবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। এর আগে ২০১৬ সালে সৌদি আরবের সাতটি স্থানে ৯টি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য মোট ৬৩৬ কোটি ১২ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে একটি উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিসি) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রকল্প মেয়াদ ধরা হয় ২০১৭ সালে জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুনরায় ব্যয় প্রাক্কলন করার সুপারিশ করা হয়। পরে ৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট দেয়া হয়। এর রিপোর্টের আলোকে ডিপিপি পুনর্গঠিত করে সৌদি আরবে সাতটি স্থানে ৯টি স্কুলের পরিবর্তে মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি দেশে মোট চারটি করে স্কুল (সৌদি আরবের রিয়াদ জেদ্দা, বাহরাইন এবং ওমান) প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর গত বছর জুন মাসে মধ্যপ্রাচ্যের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ১০টি দেশের দূতাবাসের কাছে চাহিদাপত্র চাওয়া হয়। সেখানে স্কুলের জন্য জমির পরিমাণ, মূল্য, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংখ্যা কত, শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনভাতা, স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং স্কুলটি টেকসই হবে কীনা ইত্যাদি বিষয় জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে সাতটি দেশ সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, বাহরাইন, লিবিয়া, ইরাক, ব্রম্ননাইস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস চাহিদা পাঠিয়েছে। ওমান, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এখন পর্যন্ত কোনো চাহিদা পাওয়া যায়নি। প্রবাসী মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন মিশন থেকে আপাতত ছয়টি স্কুল (সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা, মদিনা মুনওয়ারা, বাহরাইন এবং লিবিয়া) জন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকার চাহিদা পাওয়া গেছে। তবে, লিবিয়ায় বর্তমানে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করায় সেখানে আপাতত কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই বলে মতামত দিয়েছে মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, গত ৪ই সেপ্টেম্বর প্রবাসী সন্তানদের জন্য স্কুল নির্মাণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব নমিতা হালদারের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। সেখানে অর্থ, শিক্ষা, পররাষ্ট্র প্রবাসী কল্যাণ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরো (বিএমইটি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সৌদি আরবের দাম্মামে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, তাই পরীক্ষামূলকভাবে দাম্মামে একটি প্রতিষ্ঠা করা যায়। পরবর্তীতে অন্যান্য স্থানে পর্যায়ক্রমে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হবে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মো. জুলহাস এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দাম্মামে কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ এখনই শুরু করা যায়। তবে পরবর্তীতে অন্যান্য স্কুল স্থাপনের বিষয়ে তিনি ফিজিবিলিটি স্টাডি করে তার ভিত্তিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, ফিজিবিলিটি স্টাডি ভালোভাবে করতে হবে। যাতে ওইখানকার বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সংস্থা) নারায়ণ চন্দ্র বর্মা বলেন, বাহরাইনে বাংলাদেশ কমিউনিটি যে স্কুল করছে সেখানে ১২০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। স্কুলের জন্য বাহরাইন সরকার যে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে তাতে চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুলের অবকাঠামো স্থাপন না করলে জায়গা বাহরাইন সরকার বাতিল করবে। তাই বাহরাইনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্কুল ভবন স্থাপন করা দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশে কমিউনিটি কীভাবে স্কুলগুলো চালাচ্ছে তা আরও বিস্তারিত জানতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, বিদেশে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আপাতত কোনো নীতিমালা নেই। তবে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশে কমিউনিটির লোকজন আটটি স্কুল পরিচালিত করছে। যেগুলো বাংলাদেশে কারিকুলাম অনুসরণ করে এবং শিক্ষার্থীরা ঢাকা বোর্ডের অধীনে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে। তবে, সেখানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় স্কুল করলে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।