সিরাজগঞ্জে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা

প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

এইচ এম মোকাদ্দেস, সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জে পূজামন্ডপে চলছে প্রতীমা তৈরির কাজ -যাযাদি
সময় ঘনিয়ে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার। এ উৎসব উপলক্ষে ইতোমধ্যেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সিরাজগঞ্জে প্রতিমা তৈরির মৃৎশিল্পীরা। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে পূজা উদ্‌যাপন কমিটি ও প্যান্ডেল-মঞ্চের কারিগররাও ব্যস্ত সময় পার করছেন। মন্ডপে মন্ডপে চলছে পূজার আগের আনুষ্ঠানিকতা। পূজা ঘনিয়ে আসায় সিরাজগঞ্জের পালপাড়ার কারিগররা যেন দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না। কাজের চাপ বেশি থাকায় পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছেন। এখন চলছে বাঁশ, খড় আর কাদামাটি দিয়ে প্রতিমার অবকাঠামো তৈরি ও প্রলেপ দেয়ার প্রাথমিক কাজ। কাদামাটি দিয়ে পরম যত্নে দেবীর মুকুট, হাতের বাজু, গলার মালা, শাড়ীর নকশা, প্রিন্ট ও ঠাকুরের চুল তৈরি করছেন। এরপর প্রতিমাতে দেয়া হবে রংতুলির আঁচড়। দৃষ্টিনন্দন আর নানা বৈচিত্র্যময় ভঙ্গির এসব দেবী মূর্তিগুলো শৈল্পিক প্রশংসা কুড়ালেও এসব মৃৎশিল্পীদের জীবনে আসেনি কোন সৌন্দর্যময় আলোর ছায়া। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের বাজার ভদ্রঘাট পালপাড়া গ্রামে ৩০ থেকে ৪০টি হিন্দু পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে অধিকাংশই প্রতিমা তৈরির কারিগর। নারী-পুরুষ সবাই প্রতিমা তৈরির কাজ করেন। সারাবছর তাদের কদর না থাকলেও পূজার আগে কদর বেড়ে যায়। এখান থেকেই জেলার কয়েকশ' দুর্গা প্রতিমা তৈরি হচ্ছে। তবে প্রতিমা তৈরির জন্য বাঁশ, খড়, মাটিসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি তাদের কাজের মূল্য। এতে আর্থিকভাবে লাভবান না হলেও পৈত্রিক এ পেশা ধরে রাখতেই কাজ করেন তারা। মূলত প্রতিমা তৈরি করেই চলে তাদের সংসার। পূজার একমাস আগে থেকে শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। এবার শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে এখানে প্রতিমা তৈরির ধুম পড়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। প্রতিবছর দুর্গাপূজায় এ গ্রামের তৈরি প্রতিমা সিরাজগঞ্জ জেলার পাশাপাশি বগুড়া, নাটোর, পাবনা, টাংগাইল ও জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। সিরাজগঞ্জ শহরের মহাপ্রভুর আখড়া, কালীবাড়ী গোবিন্দ মন্দির, স্টেশনরোড কালিমাতা মন্দির, মাড়োয়ারীপট্টি মন্দির, বানিয়াপট্টি কালিমাতা মন্দির, ফড়িয়াপট্টি কালিমাতা মন্দির, গোশালা কালিমাতা মন্দির, বাহিরগোলা কালিমাতা মন্দির প্রাঙ্গণসহ সদর উপজেলার প্রায় শতাধিক পূজামন্ডপে এখন সারি সারি সাজানো হচ্ছে নানা আকার আর ঢংয়ের দুর্গা, লক্ষ্ণী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ আর মহিষাসুরের সঙ্গে দেবীর বাহন সিংহকে। এ বছর জেলার সিরাজগঞ্জ সদরসহ ৯টি উপজেলায় প্রায় পাঁচ শতাধিক পূজামন্ডপ তৈরি করা হচ্ছে বলে পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের নেতারা জানান। সিরাজগঞ্জের মৃৎশিল্পী প্রদীপ পাল জানান, রাতদিন জেগে কঠোর পরিশ্রম করে তিনি ও তার সহযোগীরা এ প্রতিমাগুলো নির্মাণ করছেন। বর্তমানে বাঁশ, রশি, খড়, মাটি আর রংয়ের দাম ব্যাপক হারে বাড়ালেও সে হারে দেবী মূর্তির দাম বাড়েনি। প্রতিমা তৈরিতে যে পরিশ্রম আর খরচ হয় সে তুলনায় বিক্রি করে লাভ হয় না। এ শিল্প থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিবছর সরস্বতী এবং দুর্গাপূজায় তারা ব্যস্ত সময় পার করে থাকেন। এই দুটি মৌসুমের উপার্জিত অর্থ দিয়েই তাদের পুরো বছর পার করতে হয়। ভিন্ন পেশার অভিজ্ঞতা না থাকায় অভাব অনটন তাদের ঘিরে থাকে সার্বক্ষণিক। আর এ অভাব অনটন থেকে বাঁচতে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বলে জানান প্রদীপ পাল। এছাড়া পূজায় মন্দিরে আলোকসজ্জা আর বাদ্য-বাজনাসহ আনুষঙ্গিক খরচবাবদ পূজা কমিটি অঢেল টাকা খরচ করলেও এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মজুরিবাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে চান না। হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার বছরের ঐতিহ্য আর কৃষ্টির ধারক হিসেবে বিবেচিত এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা কামনা করেন। নারী কারিগর দিপ্তী রানী পাল বলেন, 'পুরুষদের সহযোগিতা করতেই প্রতিমা তৈরিতে কাজ করছি। তবে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। একদিকে মাটি, সুতা, বাঁশ-কাঠের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাজ করে যে পরিশ্রম হয় সে পরিমাণ মূল্য আমরা পাই না। সরকার যদি সহায়তা করতো তবে আমাদের স্বচ্ছলতার পাশাপাশি এ শিল্পকে আরও উন্নত করা যেতো।' সিরাজগঞ্জ জেলা পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় কুমার সাহা জানান, আসন্ন দূর্গাপূজায় সব ধরনের প্রস্তুতির কাজ চলছে। প্রতি বছরের মতো এবারও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পূজা উদ্‌যাপনের জন্য ৯টি উপজেলার মন্দির কমিটির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এবার সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলায় ৫ শতাধিক পূজামন্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হবে।