বাদ যাবে না কেউ

শুদ্ধি অভিযান চলবে আরও তিন মাস

প্রথম ধাপে টার্গেট স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোলস্না মো. আবু কাওছার, যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, মহিউদ্দিন মহি, মাঈনুল হোসেন খান নিখিল প্রমুখ

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সোহেল হায়দার চৌধুরী
দুর্নীতি, অনিয়ম, রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় চলা সামাজিক অপকর্মের বিরুদ্ধে চলমান শুদ্ধি অভিযান প্রাথমিকভাবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা চলবে। প্রয়োজনে এ অভিযানের সময়কাল ও মাত্রা বাড়তে পারে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান ছড়িয়ে পড়েছে। জানা গেছে, শুধু রাজনীতিক নয়, অন্যান্য শ্রেণি-পেশার অপকর্মকারীরাও এ অভিযানে রেহাই পাবেন না। শুধু সময়ের অপেক্ষা। অভিযানের ক্ষেত্রে দল-মত বা বিশেষ কোনো পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এমন নির্দেশ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। অপরাধী যে দলেরই হোক ছাড় দেওয়া হবে না। প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনপ্রতিনিধি হোক আর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। জানা গেছে, চলমান অভিযানের প্রথম টার্গেট আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিডদের মধ্যে যারা অপকর্মে জড়িয়েছেন। এরপর তাদের মদদদাতাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সব শেষে দলীয় নেতাকর্মী, মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে থাকা এবং প্রশাসনে ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা অপকর্মকারীদের দিকে নজর দেওয়া হবে। সরকারের একাধিক সূত্র মনে করে, রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের একাংশ হয় সরাসরি অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত নতুবা অপকর্মে সহায়তা দেন প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে। সম্প্রতি একাধিক তদন্তে এমন চিত্র সরকারপ্রধানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, শুদ্ধি অভিযানের প্রথম ধাপে দেশে ক্যাসিনো ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও কয়েকজন ওয়ার্ড কমিশনারকে টার্গেট করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোলস্না মো. আবু কাওছার, যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, মহিউদ্দিন মহি, মাঈনুল হোসেন খান নিখিল, জাকির হোসেন, মোবাশ্বের হোসেন, জসিম উদ্দিন, এ টি এম গোলাম কিবরিয়া, কমিশনার ফরিদউদ্দিন রতন, মমিনুল হক সাঈদ ও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা তালাল রিজভী। এই চক্রের সহযোগী একসময়ের হোটেল বয় জাকির হোসেন, সাবেক হকার আরমানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক ব্যক্তি নজরদারিতে রয়েছেন। যে কোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। সূত্রটি জানায়, শাসকদল-সংশ্লিষ্ট হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারী নেতাদের সঙ্গে কিছু ত্যাগী-লোভী নেতা মিলে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছেন। এর সঙ্গে কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য রয়েছেন। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মধ্যে যারা সংসদ সদস্য হয়েছেন তাদের একাংশ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। এরাই অনুপ্রবেশকারী-হাইব্রিডদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজিতে সহায়তা করেেেছন। এই চক্রের মাধ্যমে ভারত ও নেপালের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাংলাদেশে ক্যাসিনোর ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন। অপকর্মকারী দেশি নেতাদের অনেকে আবার তাদের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। এর সব তথ্যই এখন প্রধানমন্ত্রীর নখদর্পণে। সে কারণে তিনি বারবার সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সতর্কবাণী উপেক্ষা করার ফল ভোগ করতে হবে এখন। সূত্রমতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান নিয়ে যারা বেশি মাতামাতি করছেন বা অভিযান উপেক্ষা করে শো-ডাউনের মাধ্যমে নিজের আধিপত্য প্রমাণের চেষ্টা করছেন তাদের সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট তথ্য দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে। গোয়েন্দাদের একটি গ্রম্নপ মাঠপর্যায় থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করছে। পত্রপত্রিকায় ওইসব চিহ্নিত নেতা কী বলছেন বা তাদের সম্পর্কে কী লেখা হচ্ছে, মিডিয়ায় কী তথ্য প্রচার হচ্ছে তার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে নিয়মিত জানানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির আস্থাভাজন অন্যতম এক নেতা যায়যায়দিনকে বলেন, দলীয় ও প্রশাসনিক সব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বা অনুষ্ঠানাদিতে অনেক আগে থেকেই দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপকর্মের বিরুদ্ধে বলে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি অপকর্মকারীদের সতর্ক করার পাশাপাশি তালিকা্‌ তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। ওই নেতা বলেন, আগামীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনে বদ্ধপরিকর। শেখ হাসিনা সামাজিক নৈরাজ্য বন্ধে এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দুর্নীতি-অনিয়ম ও সামাজিক অপকর্মকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ এগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তাসহ বিভিন্ন বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সমস্যা-সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নির্ধারণ করে মাঠে নেমেছেন। ওই নেতা বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একাধিক সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দুর্নীতি, অনিয়ম, অপকর্মের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছেন। এসবের সঙ্গে দল বা অন্য দলের কারা জড়িত, প্রশাসনের কারা সম্পৃক্ত বা পেশাজীবীদের মধ্যে কারা কী করছেন তা নিয়েও কথা উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী দলের অন্য নেতাদের চেয়ে অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ ছিলেন বলে সবকিছুর চুলচেরা তথ্য তিনি জানতেন এবং আলাপ করতেন। জানা গেছে, অপরাধীদের তালিকায় থাকা একাধিক ব্যক্তি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ শেখ হাসিনার আস্থাভাজন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের সহযোগিতা করতে অপারগতার কথা জানিয়েছেন সবাই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকরা এ ধরনের বিষয় নিয়ে যারাই সুপারিশের জন্য যাচ্ছেন তাদের সরাসরি না বলে দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিষয়টি টের পেয়ে স্পষ্ট বলেছেন, 'ছাত্রলীগ ধরেছি, এবার যুবলীগ ধরছি। আস্তে আস্তে সবাইকে ধরা হবে।' আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করতে দলের মধ্যে থাকা আগাছা ও পরগাছা পরিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলের মর্যাদা রক্ষায় যে কোনো নেতাকর্মীকে তার অপরাধের শাস্তি দেওয়া হবে। কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। \হ