বিসর্জনে শেষ পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ওয়াইজ ঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় -পিবিএ
যাযাদি রিপোর্ট ভক্তদের আনন্দ-অশ্রম্নতে সিক্ত হয়ে প্রতিমা বিসর্জনে বিদায় নিলেন অসুর দলনী দুর্গা। বিসর্জনের মধ্য দিয়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যাচ্ছেন দেবী। এক বছর পর আবার তার ভক্তদের মাঝে পিতৃগৃহে ফিরে আসবেন। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা থেকে রাজধানীতে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ উদ্যোগে বিজয়া শোভাযাত্রা শেষে বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাটের ওয়াইজ বিনা স্মৃতি স্নান ঘাটসহ (কেন্দ্রীয় বিসর্জন নিয়ন্ত্রণ ঘাট) অন্যান্য এলাকায় প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। দুপুর দেড়টার দিকে ওয়াইজ ঘাটে প্রথম প্রতিমা বিসর্জন দেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে যায় ধানমন্ডি পূজা উদযাপন কমিটিসহ বেশ কয়েকটি কমিটি। এদিকে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের দশমীতে মঙ্গলবার মন্ডপে মন্ডপে দশমীর বিহিত পূজার মধ্য দিয়ে ঘটে সমাপ্তি। অতপর দেবীর বিসর্জন আর 'শান্তিজল' গ্রহণ। গত শুক্রবার বোধনে অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে আনন্দময়ী মা উমাদেবীর আগমন ঘটে মর্ত্যে। হিন্দু বিশ্বাসে- টানা পাঁচদিন মৃন্ময়ীরূপে মন্ডপে মন্ডপে থেকে ফিরে যাচ্ছেন কৈলাসে স্বামী শিবের সান্নিধ্যে। আর 'শান্তিজল' গ্রহণে শেষ হচ্ছে বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। ধান-দুর্বার দিব্যি, ফের এসো মা/মা তুমি আবার এসো- ভক্তদের এমন আকুতিতে বিদায় নিচ্ছেন দেবী। আজ সকাল থেকেই বিহিত পূজার পর ভক্তের কায়মনো প্রার্থনা আর ঢাক-উলুধ্বনি-শঙ্খনিনাদে হিন্দু রমণীদের পরম আকাঙ্ক্ষিত সিঁদুর খেলায় মুখর হয়ে ওঠে মন্দিরগুলো। একদিকে বিদায়ের সুর। অন্যদিকে উৎসবের আমেজ। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এবার ওয়াজ ঘাটে ৯৭টি প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়েছে। আর এ বছর সারা দেশে ৩১ হাজার ৩৯৮টি মন্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়েছে, যা গতবারের চেয়ে ৪৮৩টি বেশি। রাজধানীতে ২৩৬টিসহ ঢাকা বিভাগে ৭ হাজার ২৭১টি মন্ডপে পূজা হয়েছে। উদযাপন পরিষদ জানায়, গতকাল দুপুর ১টা থেকে রাত দশটার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন কার্যক্রম শেষ করার কথা থাকলেও তা মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। এদিকে ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, বনানী, তাঁতী বাজার, শাঁখারী বাজার, স্বামীবাগসহ বিভিন্ন মন্ডপে চলে বিষাদে-আনন্দে শেষ বিদায় উৎসব। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী বিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে সকল অপশক্তির বিনাশ হয়। নিরঞ্জনে অংশ নিতে দুপুরের পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পূজামন্ডপ থেকে ভক্তরা ট্রাক ও ঠেলাগাড়িতে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হতে শুরু করেন ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে। শোভাযাত্রার পূর্বে নারীরা দেবীর ললাটের সিঁদুর আপন ললাটে এঁকে নেন। পুরুষরা অশুভ শক্তির বিনাশ কামনা করেন। তাদের অন্তরের কামনা আগামী শরতে আবার বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে ফিরে আসবেন মা 'উমা'। মন্দির ও শোভাযাত্রার পথে বিপুল সংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছিলর্ যাব সদস্যদেরও। ট্রাকে প্রতিমা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতা, নারী-পুরুষ, শিশু, কিশোর হেঁটে এবং বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে করে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত হয়ে ভক্তরা ঢাক-ঢোল, করতাল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রসহ শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। রাস্তার দু'পাশে দাঁড়ানো হিন্দু নারীদের উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। বিকাল তিনটার পর ঢাকেশ্বরী কেন্দ্রীয় মন্দির থেকে বিজয়ার শোভাযাত্রা শুরু হয়ে জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট, পুলিশ হেড কোয়ার্টার, গোলাপ শাহ মাজার, গুলিস্তান, নবাবপুর, রায় সাহেব বাজার হয়ে সদরঘাটের ওয়াইজ ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। প্রতিমা ঘাটে নিয়ে আসার পর ভক্তকুল শেষবারের মতো ধূপ-ধুনো নিয়ে আরতিতে মেতে ওঠেন। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে নৌকায় তুলে বিসর্জন দেয়া হয়। নদীপাড়ে ধর্মীয় রীতি মেনে অপরাজিতা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শেষে 'বল দুর্গা মায় কি, জয়' ধ্বনিতে প্রতিমা পানিতে ফেলে গ্রহণ করা হয় 'শান্তিজল'। অনেকে ঘরে আনেন সেই 'শান্তিজল'। মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কুমার রায় জানান, এবারের পূজা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। কোথাও বড় ধরনের কোনো অঘটনের খবর পাওয়া যায়নি। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের এ আয়োজন চলছে। ঢাকের বাদ্যে সিঁদুর উৎসব বাজছে অনবরত ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি। হিন্দু নারীরা পূজামন্ডপে ব্যস্ত রয়েছেন একে অপরকে সিঁদুর পরাতে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে চলছিল শেষ বেলার উৎসবের আমেজ। বিজয়া দশমী তিথিতে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানোর সময় ঘনিয়ে আসায় সবার মনে বাজছিল বিদায়ের করুণ সুর। মায়ের আশীর্বাদ হিসেবে সিঁদুর দিয়ে নিজেকে রাঙিয়ে মাকে বিদায় জানানোর শেষ পর্ব ছিল এটি। মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের চিত্র ছিল এ রকম। সিঁদুর খেলায় মেতে উঠতে নারীদের ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। সিঁদুর কিনে শেষবারের মতো দেবী দুর্গাকে পূজা দিয়ে তার পা স্পর্শ করে সিঁদুরকে পবিত্র করা হয়। হিন্দু ধর্ম অনুসারে সে সিঁদুরটি আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এ সিঁদুর নারীরা একজন আরেকজনকে পরিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং আনন্দে মেতে ওঠেন। মা বিদায় নেয়ার আগে নারীদের এমনভাবেই আশীর্বাদ করে যান। জানালেন মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি। তিনি বলেন, 'আবারও এক বছর পর মা আসবেন আমাদের মাঝে। সে পর্যন্ত নারীরা এ আশীর্বাদ নিয়েই থাকবেন। মা সবার উদ্দেশ্যে শান্তি ও সমতার বাণী নিয়ে এসেছিলেন পৃথিবীতে, আবার মর্ত্যলোকে তার স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার আগেই তিনি বিবাহিত নারীদের আশীর্বাদ করেন। মাকে তার স্বামীর কাছে পুনরায় যেতে দেওয়ার আগে এটাই সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক পূজার অংশ। এর পরে সবাই বিসর্জনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।' ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে খেলাটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস। এ সময় তিনি তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত পাশাপাশি অবস্থিত প্রতিবেশী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশ। এ বন্ধুত্বের হাত আরও শক্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছে সর্বশেষ ভারতের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে। এতে আমরা আশা করতে পারি, দেশ দুটির সম্পর্ক আরও বেশি গভীর হবে। তাছাড়া এতবড় একটি ধর্মীয় উৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকারকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। সিঁদুর খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাবেক সভাপতি দীপেন চ্যাটার্জি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়াসহ মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির অন্য সদস্য ও সিঁদুর খেলায় মত্ত অসংখ্য নারীরা। এ বিষয়ে সিঁদুর খেলতে আসা প্রিয়া সাহা বলেন, 'মাকে বিদায় জানাতে ও মায়ের আশীর্বাদপুষ্ট সিঁদুর নিতে দশমীতে মন্দিরে এসেছি। আমি আমার স্বামী সন্তানদের নিয়েই এসেছি। সিঁদুর খেলাতে অংশগ্রহণ করেছি। যা সারা বছরের কাঙ্ক্ষিত একটি সময়। মায়ের আশীর্বাদপুষ্ট সিঁদুর আমার স্বামীর হাতেও পরিয়েছি।' এদিকে, ধর্মকে মূল পুঁজি না করে উৎসবকে মনে ধারণ করে ঢাকেরশরী মন্দিরে অনেক মুসলিম নারীকে উপস্থিত হতে এবং এই আনন্দে শামিল হতে দেখা গেছে। নাচে-গানে তারাও মেতে উঠেছিলেন সিঁদুর খেলায়। তেমনই একজন নারী আতিয়া রহমান আন্নি। তিনি বলেন, 'হিন্দু সংস্কৃতি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো সংস্কৃতি। দেশীয় সংস্কৃতির প্রতিটি পরতে পরতে এ ধর্মটির প্রভাব রয়েছে। আর সাম্প্রদায়িকতা বাদ দেওয়ার ভাষা আমাদের সবার মনের মধ্যে থাকলেও হয়তো বা বিভিন্ন সামাজিক কারণে তা করে উঠতে পারি না আমরা। আমি সবসময় চেষ্টা করি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। তাই আমিও সরকারি ছুটির দিনে নারীদের অত্যন্ত আনন্দদায়ক ধর্মীয় অনুষ্ঠান সিঁদুর খেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য এসেছি।'