একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে আবরারের খুনিরা

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ছাত্রলীগের ৩ নেতাকে বুধবার আদালতে হাজির করে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ -ফোকাস বাংলা
এর আগে বহুবার সবাই একসঙ্গে মিলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে পরে এ ব্যাপারে কে কতটা জোরালো ভূমিকা রেখেছে তা নিয়ে সহপাঠী ও বন্ধুদের কাছে গর্ব প্রকাশ করলেও এবার আবরারকে পেটানোর দায় একে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রেপ্তারকৃত নেতারা। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এদের প্রায় সবাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে আবরারকে চড়-থাপ্পড় মারার কথা স্বীকার করলেও তাকে কেউ গুরুতর আঘাত করেনি বলে দাবি করছে। তবে তাদের পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তারা প্রত্যেকেই নিজেকে 'সেফ সাইডে' রেখে অন্যরা হকি স্টিক, লাঠি ও রড দিয়ে কে কিভাবে পিটিয়েছে, কে আবরারের স্পর্শকাতর জায়গায় কতটা জোরে লাথি মেরেছে তা গোয়েন্দাদের রীতিমতো অঙ্গভঙ্গি করে দেখিয়েছে। আবরারকে মারধরের আগে তাদের মধ্যে কে কোথায় কতটা মদ খেয়ে কিভাবে মাতাল হয়েছিল, আর এ নেশার ঘোরে তারা কতটা হিংস্র হয়ে তাকে মারধর করেছে, তার হুবহু ফিরিস্তি দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, যেহেতু তারা এখন পর্যন্ত আবরারের খুনের প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে খুঁজে পায়নি, তাই তারা কৌশলে খুনিদের কাছ থেকেই নির্যাতনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। পরে এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ করে 'সামারি' (ঘটনার সারাংশ) তৈরি করা হবে। এর সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন পরিস্থিতি, ভিডিও ফুটেজ, নির্যাতনকারীদের ভূমিকা, রুমমেটসহ অন্যদের জবানবন্দি ও খুনের বিভিন্ন আলামত পর্যবেক্ষণ করলেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। নির্যাতনকারীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম দোষী কাউকে রাজসাক্ষীও করা হতে পারে। তবে এর সব কিছুই তদন্তের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করছে। আবরার খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নির্যাতনকারীদের মধ্যে অনিক সরকার সবচেয়ে বেশি মাতাল ছিল। আর এ কারণেই সে উন্মাদের মতো আবরারকে পিটিয়েছে বলে নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্তত চারজন অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃতরা অধিকাংশই আবরারকে মারধরের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলকে দায়ী করে জবানবন্দি দিয়েছে। এদিকে অনিক সরকার নিজে মাতাল থাকার কথা স্বীকার করে জানিয়েছে, তার সঙ্গে পূজা দেখতে গিয়ে জিয়ন ও সকালসহ আরও অনেকে মদ খেয়েছে। এ কারণে ঘটনার সময় তারা তাদের হিতাহিত জ্ঞান কিছুটা হারিয়ে ফেলেছিল। তবে আবরারকে মেরে ফেলার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না বলে জোর দাবি করে অনিক। যদিও গোয়েন্দাদের পৃথক জিজ্ঞাসাবাদে জিয়ন ও সকাল মদ পান করার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। তাদের ভাষ্য, অনিক নিজের দায় তাদের ঘাড়ে চাপাতেই এ ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। অনিক দীর্ঘদিন ধরে মদের নেশায় আসক্ত এবং মাতাল হয়ে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানোর কারণে ছাত্রলীগের হাইকমান্ড থেকে তাকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ অন্য মাধ্যমে ভিন্নমতের পোস্ট দেয়াসহ বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে বুয়েট ছাত্রলীগের কর্মীরা অহরহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হতো। এটি তাদের অনেকটা নিত্যদিনের 'কার্যক্রমে' পরিণত হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করার সাহস না পাওয়ায় এ চক্র দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নিবিড় তদন্ত করে প্রকৃত খুনিদের দ্রম্নত চিহ্নিত করার পাশাপাশি পলাতক খুনিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেন গোয়েন্দা পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম বুধবার বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলেছেন। তারা তাদের কাছ থেকে আবরার হত্যাকান্ডের বেশকিছু নতুন তথ্য পেয়েছেন, যা খুনিদের চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে বলে দাবি করেন তারা। শেরেবাংলা হলের একজন শিক্ষার্থী গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, রাতে খাবার আনতে নিচে নামার সময় তিনি সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে একটি তোষকের ওপর আবরারকে পড়ে থাকতে দেখে। এ সময় সে হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা তাকে হুমকি দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। ওই সময় আবরারের দুই চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছিল এবং মুখের দুই পাশে ফেনা লেগে ছিল বলে জানান ওই শিক্ষার্থী। একই হলের আরও একজন শিক্ষার্থী আবরারের নিথর দেহ সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে পড়ে থাকতে দেখে নিচে না নেমে রুমে ফিরে আসে এবং বিষয়টি রুমমেটদের অবহিত করে। তবে তারা এ ব্যাপারে তাকে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার কথা বলে। হলে এ ধরনের ঘটনা অহরহই ঘটে এবং এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে গেলে তার ওপরও নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে বলে তাকে সতর্ক করে ওই শিক্ষার্থী। এদিকে মহিউদ্দিন ও আরাফত নামের দুই শিক্ষার্থী ছাত্র বিক্ষোভে অংশ নিয়ে জানান, আবরারকে গভীর রাতে সিঁড়িতে কাতরানো অবস্থায় দেখে তারা ডাক্তার ডাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছাত্রলীগ নেতা জিয়ন তাদের জানায়, আবরারের তেমন কিছুই হয়নি, সামান্য মার খেয়েছে। সিনক্রিয়েট করার জন্য ভান ধরেছে। বুয়েট ছাত্রলীগের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, হলে হলে টর্চার সেল এবং তুচ্ছ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমান্ড জানত। তবে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের সঙ্গে রাব্বানির ঘনিষ্ঠতা থাকায় তাকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পেত না। এ কারণে তার ইশারাতেই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চলত। তারা তাদের দীর্ঘদিনের পাপের ফাঁদে পড়েছে বলে মন্তব্য করে ওই ছাত্রলীগ কর্মী। এদিকে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একাংশ খুনিরা গ্রেপ্তার হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে তারাসহ কেউই গত দুই দিন ক্যাম্পাসে ঢুকতে সাহস পায়নি। তাদের আশঙ্কা, ক্যাম্পাসে যে ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে ছাত্রলীগের কে নিরীহ, কে দোষী তা বিচার করার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হাতে বুয়েট ছাত্রলীগের যে কেউ হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করে অনেকেই। বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা এ প্রতিবেদককে জানায়, তাদের কমিটির সাধারণ সম্পাদকসহ বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতাই আবরার হত্যাকান্ডে ফেঁসে গেছে। এদের মধ্যে দুই-একজন সৌভাগ্যক্রমে এ জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও বাকিদের সামনে কঠিন সাজা অপেক্ষা করছে। এ অবস্থায় বুয়েট ছাত্রলীগে নেতৃত্ব সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া আবরার হত্যাকান্ডের পর ছাত্রলীগের যে ইমেজ সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠাও খুবই কঠিন হবে। তাই নেতাদের পাশাপাশি সাধারণ কর্মীরাও চরম হতাশ হয়ে পড়েছে।