আবরারের স্পর্শকাতর অঙ্গেও সজোরে আঘাত করে একাধিক খুনি

হত্যাকান্ডের নেপথ্যে ভিন্ন কারণ থাকার সন্দেহ গোয়েন্দাদের আবরারের শিবির সংশ্লিষ্টতার কথা জানায় রুমমেট মিজান খুনিদের অন্তত তিনজন জামায়াত-শিবির পরিবারের

প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
আবরার ফাহাদ
শুধু আবরারের হাত-পা ও পিঠে নৃশংসভাবে রড, লাঠি ও স্টাম্প দিয়ে পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি খুনিরা। একাধিক খুনি বেশ কয়েক দফা তার স্পর্শকাতর অঙ্গেও সজোরে আঘাত করে। বেধড়ক পিটুনিতে আবরার ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলে তারা তার মাথাও জোরে মেঝেতে ঠুকে দেয়। এতে তিনি আর্তচিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ সময় তার চোখেমুখে পানি ছিটানো হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর আবরার চোখ মেলে তাকালে ফের শুরু হয় নির্যাতন। একদল তাকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে অন্য দল তখন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এভাবেই নৃশংস নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে খুনিরা। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের বাইরে আরও অন্তত দুজন নির্যাতনকারী রয়েছে, যারা আবরারকে সবচেয়ে বেশি মারধর করেছে বলে তারা দাবি করেছে। এদের মধ্যে একজন পুরোপুরি মাতাল অবস্থায় বেশ কয়েক দফা তার গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এছাড়া অনিক সরকার তার সেখানে জোরে লাথিও মেরেছে বলে গ্রেপ্তারকৃত তিনজন গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। যদিও অনিকের দাবি, আবরারকে নির্যাতন শুরুর অল্পকিছু আগে সে মদ খেয়ে কিছুটা নেশার ঘোরে ছিল। তবে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যভাবে তাকে মারধর করেনি। বরং স্পর্শকাতর কোথাও যাতে আঘাত না লাগে এ ব্যাপারে সে সচেতন ছিল। কেউ এ ধরনের কিছু বলে থাকলে তার ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অভিযোগ করে অনিক। এদিকে গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, বেশ আগে থেকেই আবরার তার ফেসবুকে ভারত বিদ্বেষী বিভিন্ন পোস্ট দিলেও ছাত্রলীগের নেতারা তা জানত না। এ কারণে তারা এত দিন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে সম্প্রতি আবরারের রুমমেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটার রিসোর্চ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান এ বিষয়টি ছাত্রলীগের নেতাদের অবহিত করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা আবরারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করে এবং গত ৩০ সেপ্টেম্বর ও ৫ অক্টোবরের দুটি ভারতবিদ্বেষী পোস্টসহ এ ধরনের আরও বেশকিছু পোস্ট পায়। এছাড়া আবরার অনলাইনে শিবিরের কার্যক্রম চালাত বলেও মিজানুর ছাত্রলীগ নেতাদের তথ্য দেয়। অথচ তার ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন ঘেঁটে এ ধরনের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যে কারণে এ ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ আদায়ের জন্যই তারা আবরারকে বেধড়ক পেটায়। তবে বৃহস্পতিবার দুপুরে গোয়েন্দারা মিজানুর রহমানকে তার রুম (২০১১) থেকে আটকের পর সে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে। তার দাবি, আবরার গ্রামের বাড়ি থেকে কবে হলে ফিরে আসে তা জানানোর জন্য ছাত্রলীগ নেতারা তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। তাই তার (আবরার) হলে ফেরার খবর সে তাদের জানিয়েছিল। এর বাইরে এ ঘটনার সঙ্গে তার আর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলে মিজানুর দাবি করেছে। এদিকে শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হলেও এ হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী চক্রের অন্যতম হোতা বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড জামায়াতের বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। জানা গেছে, তার বাবা রাজশাহীর পবা থানাধীন চৌমুহনীর কাপাসিয়া এলাকার বাসিন্দা মাকসুদ আলী জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। রবিনের দাদা মমতাজ উদ্দিন জামায়াতের ব্যানারে মেম্বার নির্বাচনও করেছিলেন। চাচা ইমরান আলীর বিরুদ্ধে জামায়াতের পক্ষে নাশকতা চালানোর চারটি মামলা রয়েছে। অথচ এই রবিনও গত ঈদুল ফিতরের আগে কৌশলে ছাত্রলীগের কমিটিতে ঢুকে পড়ে। তার নেতৃত্বে বুয়েটের আরও অন্তত এক ডজন শিক্ষার্থী শিবির সন্দেহে মারধরের শিকার হয়েছে। রবিন ছাড়াও আবরারের আরও দুই খুনির পরিবারের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার তথ্য গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। তবে এ ব্যাপারে এখনো সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের হাতে আসেনি। তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জামায়াত-শিবিরের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে এসব শিক্ষার্থী কীভাবে বুয়েট ছাত্রলীগের কমিটিতে ঢুকল, তাদের নেপথ্যে কারা সহযোগিতা করেছে তা-ও খুঁজে দেখা হচ্ছে। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, ভারতবিদ্বেষী স্ট্যাটাস কিংবা ছাত্রশিবির সন্দেহে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে- এ বিষয়টি প্রথম থেকে সামনে এলেও এর নেপথ্যে আরও একাধিক অন্য কারণ থাকতে পারে। যা তারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে। এছাড়া আবরারকে হত্যার সময় বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ভিডিও ফুটেজে যাদের দেখা গেছে কিংবা যাদের এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে, তার বাইরে আরও কেউ আছে কি না গোয়েন্দারা সে বিষয়েও গভীর অনুসন্ধান চালাচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্যের বাইরে আরও কোনো চাঞ্চল্যকর তথ্য আছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। এ জন্য গ্রেপ্তারকৃতদের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নানা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে গোয়েন্দারা। দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, আবরারকে পিটিয়ে হত্যার পর খুনিরা প্রায় সবাই বিভিন্নজনকে একাধিক ফোন করেছে। এসব ফোনের ভয়েস কল রেকর্ড সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। এদের ভয়েস কল রেকর্ড থেকে হত্যাকান্ড সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে। এছাড়া তারা গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে সঠিক তথ্য দিয়েছে কি না তা-ও জানা যাবে বলে আশাবাদী গোয়েন্দারা। এদিকে লাঠি-রডসহ বিভিন্ন ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবরার মারা গেছে, প্রাথমিকভাবে এমন ধারণা করা হলেও এটি কতটা সঠিক তা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, খুনিরা তাকে যেভাবে স্পর্শকাতর অঙ্গে আঘাত করার কথা জানিয়েছে, তাতে এ কারণেও আবরারের মৃতু্য হতে পারে।