ক্যাসিনো বাণিজ্যে সরাসরি পাঁচ প্রভাব অর্থনীতিতে

এসব অর্থ যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে, দেশের উন্নয়নে কোনো কাজে আসে না এর মাধ্যমে দুর্নীতি উৎসাহিত হয় অর্থের বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয় দ্রব্যমূল্য বাড়ে, মুদ্রাস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকট সৃষ্টি করে

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আহমেদ তোফায়েল এ সময়ের আলোচিত বিষয় হলো 'ক্যাসিনো'। ক্যাসিনো থেকে উপার্জিত অর্থের একটা অর্থনৈতিক দিক থাকলেও এই টাকা শুধু ক্যাসিনোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। নানা কাজে এসব অর্থের অপব্যবহার হয় এবং এই টাকার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার করা হয়। যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি। আর্থিকখাত বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদিও বাংলাদেশে 'ক্যাসিনো বাণিজ্য' নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি, তার পরেও ক্যাসিনো টাকা অর্থনীতিতে কমপক্ষে পাঁচ ধরনের প্রভাব সরাসরি পড়ে। তাদের মতে, ক্যাসিনোর অর্থ যায় অনুৎপাদনশীল খাতে যা দেশের উন্নয়নে কোনো কাজে আসে না; ক্যাসিনো কালো টাকা উৎপাদনের কারখানা, এর মাধ্যমে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়; এর বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকট সৃষ্টি করে। 'ক্যাশ ইন হ্যান্ড' বেড়ে গেলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, যার কারণে মুদ্রাস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ক্যাসিনোতে কালো টাকার মালিকরা যান। তারা রাজনীতিকেও কালো করে দিয়েছেন। ক্যাসিনো জুয়া দেশে পুরোপুরি অবৈধ। এর কোনো ইতিবাচক দিক নেই। দেশের অর্থনীতির বড় অংশ কালো টাকা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কালো টাকা উপার্জনে আরও বেশি উৎসাহ পায়। অবৈধ উপায়ে যারা অর্থ বিত্তের মালিক হন তারা এখানে যান। ক্যাসিনোতে কখনো সাদা টাকা যায় না। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'আপাতদৃষ্টিতে ডলার মার্কেটে ক্যাসিনোর প্রভাব পড়ে বলে ধরা যায়। বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে গেছে বলে মনে করা যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ক্যাসিনো অর্থনীতি হলো একটি অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। যা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন থেকে এসেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে তারা ক্ষমতাশালী হয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা ক্যাসিনো অর্থনীতি সৃষ্টি করেছেন। ক্যাসিনো অর্থনীতির কারণে তারা প্রভাবশালী হয়ে গেছেন। এ অর্থনীতির বিশাল একটি অংশ তারা বিদেশে পাচার করেছেন। এসব করে তারা অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, রাজনীতি এবং অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন বাড়তে বাড়তে এমন এক জায়গায় ঠেকেছে যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য তারা বড় বিপদ ডেকে আনছে এবং হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, ক্যাসিনো অর্থনীতির কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই অর্থনীতিতে। এতে সমাজে দুর্বৃত্তায়নের সৃষ্টি হয়। এখানে কালো টাকার উৎপত্তি হয় এবং এসব টাকা বিদেশে পাচার হয়। সব মিলিয়ে সমাজে দূর্নীতি উৎসাহিত হয়। আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্যাসিনো অর্থনীতির সঙ্গে তারল্য বেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থনীতিতে যখন নগদ অর্থ প্রবাহের সংকট দেখা দেয়, তখন তাকে তারল্য সংকট বলে। তারল্য যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের মূল চালিকাশক্তি। ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকেরা হাতে নগদ টাকা রাখেন। তাই ক্যাসিনো অর্থনীতির আকার বাড়লে হাতে নগদ অর্থ রাখার প্রবণতা বাড়ে। তাই যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকট সৃষ্টির পেছনে ক্যাসিনো বাণিজ্য দায়ী। ক্যাসিনোতে ওভারনাইট বেশ বড় ধরনের ক্যাশ ইন ফ্লো এবং আউট ফ্লো ঘটে, যা মানি মার্কেটকেও অস্থিতিশীল করে। অন্যদিকে এর প্রভাবে মানুষের কাছে যখন 'ক্যাশ ইন হ্যান্ড' (হাতে নগদ টাকা) বেড়ে যায়, তখন মুদ্রাস্ফীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পণ্য ও সেবার মূল্য টাকার অঙ্কে বেড়ে যায়। সহজভাবে বললে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এটি পুরো দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এছাড়া, নগদ অর্থের জোগান পেতে ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে, যা দ্রব্যমূল্য বাড়াতে ভূমিকা রাখে। অপরদিকে, ক্যাসিনো ব্যবসায় কালো টাকার ব্যবহার সর্বাধিক। ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়ে। ক্যাসিনো যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বিদ্যমান, তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাচারের পথটি বেশ প্রশস্ত। জানা গেছে, ১৬৩৮ সালে ইতালির ভেনিসে আনুষ্ঠানিকভাবে জুয়া খেলার আয়োজন করা হয়। তবে এ খেলাকে ১৯৩১ সালে আইনি প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে স্থান দেয় যুক্তরাষ্ট্র; নেভাদায় প্রতিষ্ঠা পায় 'ক্যাসিনো'। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বৈধ ক্যাসিনোর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং তা বিশ্বের শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর আবার লাস ভেগাস শীর্ষে, যার বার্ষিক আয় প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। জুয়া খেলার এমনই বাহার যে, লাস ভেগাসের ক্যাসিনো মালিকদের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। জানা গেছে, পৃথিবীজুড়ে জুয়া খেলার আয়োজনটি বিশাল। প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের একটি 'শিল্প' বলা যায়। শিল্প টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৪২ লাখ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের ৮ গুণ! সেই জুয়া আবার এখন একটি নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে আটকে নেই, অনলাইনেও চলছে। ২০১৭ সালে অনলাইনে জুয়ার বাজারে ঘোরাঘুরি করেছে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, কানাডাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে 'ক্যাসিনো' অনেক পরিচিত নাম। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলও পিছিয়ে নেই। ২০১৫-১৬ সালে সারা বিশ্বে ক্যাসিনো থেকে যে পরিমাণ আয় হয়েছে, তার ৪৪ শতাংশই এসেছে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে। বাংলাদেশের অবৈধ ক্যাসিনোগুলোতে কর্মরত আছে প্রায় ২০০ নেপালি নারী-পুরুষ। সম্প্রতি দেশে ক্যাসিনো অভিযানের মাধ্যমে জানা গেছে, সারা বিশ্বের যে ক্যাসিনো কালচার তার থেকে আমাদের দেশের ক্যাসিনো কালচারের অনেকখানি তফাত রয়েছে। ক্যাসিনো অপারেশনের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে অবৈধ অর্থ-সম্পদের খবর, ঘুষ-দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চোরাকারবারি, কমিশনভোগী, সন্ত্রাসী, কালো টাকা, অর্থ পাচারের মতো লোমহর্ষক ঘটনা। ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে জানতে চাইলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন যায়যায়দিনকে বলেন, সুশাসনের জন্য এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। সুশাসনের উন্নতি হলে বিনিয়োগ বাড়বে। উৎপাদনশীল খাতে অর্থের প্রবাহ বাড়বে, অর্থের গুরুত্ব বাড়বে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। এ ধরনের উদ্যোগের ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বাড়বে।