নতুন সংকটে পুঁজিবাজার আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
আস্থা, তারল্য সংকট, সুশাসন, অর্থমন্ত্রী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসির আশ্বাস এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ, কোনো কিছুতেই যখন কোনো কাজ হচ্ছে না তখন পুঁজিবাজারে নতুন সংকট যোগ হয়েছে। আর তা হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মান কমিয়ে ডলার শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত। অন্যটি গ্রামীণফোন ও রবিতে প্রশাসক নিয়োগের খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাজার সংশিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা \হশেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বাজার থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। তারা কয়েকটি কারণে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। যেমন, টাকার অবমূল্যায়ন, গ্রামীণফোনের শেয়ার নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে ঝামেলার সম্মানজনক সমাধান না হওয়ায় তাদের কাছে থাকা জিপির শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকার গ্রামীণফোন ও রবি ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়ার খবরে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। এসব মিলিয়ে অব্যাহত দরপতনে দেশি বা স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। ছোটবড় সব বিনিয়োকারী বুঝে উঠতে পারছেন না বাজার কোথায় গিয়ে ঠেকবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বৃহস্পতিবার যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মান দুর্বল করে ডলার শক্তিশালী করতে শুরু করেছে। গত তিন-চার দিন আগে ২০ পয়সা কমিয়েছে। বাজারে গুজব আছে, এবার ডলার ৯০ টাকা পর্যন্ত যাবে। টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়। সে কারণে তারা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। সাবেক এ সভাপতি বলেন, দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীরাই বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। বাজার বোধ হয় আরও পড়বে; ভয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন শেয়ার। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিদেশিরা যখন ৮২ টাকায় ডলার বাংলাদেশে নিয়ে আসবেন, তখন তাদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিয়ে ডলার কিনতে হবে ৯৬ টাকায়। এই যে ১৪ টাকা ফারাক হলো এই টাকাটা তাদের লোকসান হয়ে গেল। এটা হয়ে থাকে যখন টাকার অবমূল্যায় হয়। তখন তারা ব্যবসাও গুটিয়ে নেয়। এটা পুঁজিবাজারের জন্য এক নতুন সংকট বলে মনে করেন তিনি। এদিকে, দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক প্রায় ৯ মাসে কমেছে ১ হাজার ২০০ পয়েন্ট। একই সময়ের ব্যবধানে বাজার মূলধন বা শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এভাবেই দেশের শেয়ারবাজার সূচক তলানিতে নেমে যাচ্ছে। কারণ, বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। সূচক যেমন তলানিতে, আস্থাও তলানিতে। এতে প্রতিদিনই কমছে শেয়ারের দাম, সে সঙ্গে কমছে সূচক ও লেনদেনও। এ প্রসঙ্গে ডিবিএ সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, বিষয়টা আস্থার সংকট তা তিনি মনে করেন না। কারণ, আবার যখন বাজারে বিনিয়োগ আসবে তখন আস্থাহীনতা থেকেই আস্থাটা আসবে। বাজার এখন বটম আউটে চলে এসেছে। তার মানে, শেয়ারের দাম এমন পর্যায়ে এসেছে যে, শেয়ারের দাম আর পড়ার তেমন সুযোগ নেই। তিনি মনে করেন, বাজার খুব শিগগিরই ভালো অবস্থানে ফিরে আসবে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে রেপোর মাধ্যমে অর্থ সরবারহ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার বেসরকারি সিটি ব্যাংককে ৫০ কোটি টাকার তহবিল ছাড় দিয়েছে। এ খবরেও বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ অর্থ পুঁজিবাজারে আসছে এটা ভালো খবর। ফলে বাজারে বিনিয়োগ বাড়বে, তারল্য সংকট কমবে। তবে ১৫টির মতো ব্যাংক রেপোর অর্থ নেয়ার সক্ষমতা থাকলেও মাত্র একটি ব্যাংক এ অর্থ নিচ্ছে। এটা খুবই সামান্য। সবগুলো ব্যাংক এ অর্থ নিয়ে বিনিয়োগ করলে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা খাত সংশ্লিষ্টদের। এদিকে, গ্রামীণফোন ও রবি ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। সরকারের শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ফলে এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে বেসরকারি টেলিকম সংস্থা দুটির কাছে সরকারের দাবিকৃত ১৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। প্রশাসক নিয়োগের খবরেও গতকাল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উলেস্নখ্য, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দুটি পৃথক অডিটের মাধ্যমে এই অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদনের জন্য গত ১৫ অক্টোবর বিটিআরসি দুটি চিঠি পাঠিয়েছে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। চিঠিতে প্রতিটি সংস্থায় চারজন প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডিবিএ সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, এ রকম খবরে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ সিন্ধান্ত নেয়ার আগে বাজারে কী প্রভাব পড়বে তা বিএসইসির সাথে বসে ঠিক করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, একসময় আইডিআরএ একটি বিমা কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছিল। এরপর বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে গেল। দেশীয় বিনিয়োগকারীরা পথে বসল। পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, বিনিয়োগকারীরা সবাই শেষ। এমনিতেই শেয়ারের চাহিদা নেই। প্রচুর বাজে শেয়ার পুঁজিবাজারে দেয়া হয়েছে আইপিওর মাধ্যমে। একদিকে পুঁজিবাজারে টাকার অভাব আরেক দিকে অনেক শেয়ার। বাজার ভালো হবে কীভাবে? তার ওপর টাকার অবমূল্যায়ন এবং গ্রামীণফোন ও রবির ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রশাসক নিয়োগের ঘোষণায় বাজার কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে আতফঙ্ক আছেন তারা। গত তিন বছর ধরে ৮ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) অর্জিত হচ্ছে বাংলাদেশে। কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন পুঁজিবাজারে দেখতে না পেয়ে অবাক লালী ও মিজানুর। এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেডের সিইও মাহবুব এইচ মজুমদার বলেন, রেগুলেটরদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। তিতাস গ্যাস, বিমা, গ্রামীণফোন এগুলোর যে ঘটনাগুলো ঘটছে এসব ঘটনাই ক্যাপিটাল মার্কেটেও প্রভাব ফেলছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশিরা ডিএসইর মাধ্যমে ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭১ হাজার ৪৮০ টাকার শেয়ার কিনেছেন। এর বিপরীতে তারা বিক্রি করেছেন ৩১৮ কোটি ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৮৮ টাকার শেয়ার। শুধু সেপ্টেম্বরেই বিদেশিরা ৬০ কোটি ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩০৮ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। আগের মাস আগস্টে বিদেশিরা ১৭৬ কোটি টাকার শেয়ার কিনলেও বিক্রি করেছেন ২৭৯ কোটি টাকার শেয়ার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার বিক্রি করে, তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তার মতে, দেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ না বাড়ানোর কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার কিনছেন না। এ জন্য শেয়ারবাজারে এই মুহূর্তে বড় ও ভালো বিনিয়োগ জরুরি। ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, 'ভালো শেয়ার বা বড় শেয়ার নতুন করে এলে সূচক বাড়বে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সূচক দেখেই শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণে সূচক বাড়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আর সূচক বাড়লে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়ে। তখন লোকজন ভালো শেয়ারের পাশাপাশি অন্য শেয়ারও কিনবে।