একান্ত সাক্ষাৎকারে রাশেদ খান মেনন

কিছু বাড়াবাড়ি হলেও নির্বাচন অশুদ্ধ হয়নি

প্রকাশ | ২২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
রাশেদ খান মেনন
সোহেল হায়দার চৌধুরী বিগত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছে দাবি করে সাবেক মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেছেন, তিনি যেভাবে কথাগুলো বলেছেন মিডিয়া সেভাবে তা তুলে ধরেনি। তার বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপন না করে অংশবিশেষ উপস্থাপন করায় এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তিনি সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর দেয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, 'একাদশ সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়।'- এটা সত্যি যে, বিগত জাতীয় নির্বাচনে কিছু বাড়াবাড়ি আছে, তার মানে এই নয় যে, নির্বাচন অশুদ্ধ হয়েছে। বিএনপি-জামাতচক্র নির্বাচনে এলেও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। যা এখনো অব্যাহত আছে। গত শনিবার বরিশালে ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যের সূত্র ধরে রাশেদ খান মেনন যায়যায়দিনের মুখোমুখি হন সোমবার। দলীয় কার্যালয়ে বসে তিনি বরিশালে দেওয়া তার বক্তব্য, জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য, ক্যাসিনো প্রসঙ্গ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, ভর্তি-বাণিজ্য, ১৪ দলের বর্তমান কর্মকান্ড, সরকারের অবস্থান, নিজ দলের আসন্ন কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। গণমাধ্যমে প্রকাশ, রাশেদ খান মেনন গত শনিবার বলেছিলেন, 'বিগত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীসহ আমিও বিজয়ী হয়ে এমপি হয়েছি। এরপরও আমি সাক্ষী দিয়ে বলছি বিগত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। বিগত জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ।' তিনি বলেছেন, 'উন্নয়ন মানে গণতন্ত্র হরণ নয়, উন্নয়ন মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ নয়। আজ দেশের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে সরকার। তাই মুখ খুলে কেউ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছে না।' এর সূত্র ধরে সরকারি মহল ও ১৪ দলের নেতাদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করলে রাশেদ খান মেনন তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলেন, 'গণমাধ্যমে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে।' আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মতে মেনন মন্ত্রিত্ব না পাওয়ায় এমন বক্তব্য দিয়েছেন। মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার অন্তর্জ্বালা থেকে কি এমন বক্তব্য দিয়েছেন, জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, এরকম কোনো বিষয় তার মধ্যে কাজ করে না। ওবায়দুল কাদের ভালোভাবেই জানেন তিনি প্রথমে মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করেছেন। পরবর্তীতে উনি ফোন করে এ বিষয়ে তাকে অনুরোধ করায় রাজি হন। তিনি বলেন, যদি নির্বাচন নিয়ে বা সরকার নিয়ে বড় ধরনের কোনো ক্ষোভ থাকত তবে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিতেন না। সে সময় বিএনপি-জামায়াতের তান্ডবের কারণে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের সঙ্গে ছিলেন। ক্যাসিনোকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি ঢাকতে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছেন কিনা জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ক্যাসিনোকান্ডের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাই এটিকে আড়াল করার কি আছে? তিনি বলেন, তার সংসদীয় এলাকায় ক্যাসিনো থাকলেও তার জানা ছিল না। যেখানে বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে থাকা থানাই বিষয়টি জানত না, সেখানে তার জানাতো দূরের কথা। তাছাড়া ইয়ংম্যান্স ক্লাবের সঙ্গে তাকে জড়ানো হলেও তিনি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ঐ ক্লাবে একদিন মাত্র গিয়েছেন। 'বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়' বলতে কি বোঝাতে চাইছেন জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, জনগণ নির্বাচনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে, সেটাই বলতে চেয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলে বিতর্কে পড়লেও নির্বাচনী ব্যবস্থা শক্তিশালী করার উপর গুরুত্বারোপ করেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, অতীতে ভোটের অধিকারের জন্য দলীয় এবং জোটগতভাবে লড়াই করেছেন। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে দাঁড় করাতে হবে এবং নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সামগ্রিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থার উপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে উলেস্নখ করে মেনন বলেন, এটা গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, যে রংপুর জাতীয় পার্টির ঘাঁটি সেখানে বিগত উপ-নির্বাচনে এরশাদের ছেলে প্রার্থী হবার পরেও মাত্র ২১ শতাংশ ভোট পড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। রাশেদ খান মেনন বলেন, আসলে এখন আর মহাজোট সরকার বলা হয় না, বলা হয় আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগ মনে করছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এককভাবে সরকারে থাকলে যে সুবিধা হবে জোটগতভাবে থাকলে তা হবে না, কিছু অসুবিধা তৈরি হতে পারে। তাই জোট সরকারের বদলে একক সরকার। নির্বাচন নিয়ে তার দেয়া বক্তব্যে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ১৪ দলের ঐক্য অটুট থাকবে কিনা বা ১৪ দলের আন্তঃসম্পর্কে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে কিনা জানতে চাইলে জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন বলেন, এ বক্তব্যের সূত্র ধরে ১৪ দলীয় জোটে ভুল বার্তা গেছে সেটা ঠিক। তবে ঐক্য বিনষ্ট হবে না বা আন্তঃসম্পর্কে সংকট হবে না। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার, আইনের শাসন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে ১৪ দল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু দেশে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান হয়নি। এসব চলমান থাকায় রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন ১৪ দলকে তার ভূমিকা অটুট এবং কার্যকর জোট হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এসব বিষয়ে শক্তিশালীভাবে লড়াই করতে হবে। নানা বিতর্ক এবং ব্যক্তিগত অবমূল্যায়নের সূত্র ধরে ১৪ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, এখানে ব্যক্তিগত মর্যাদার বিষয় নয়। বিষয়টা হলো আদর্শিক। ১৪ দলের নীতি ও মূল্যবোধ বজায় থাকলে সঙ্গে থাকবেন। একেবারেই তা ভেঙে পড়লে নতুনভাবে চিন্তা করবেন। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। মাথাপিছু আয় এবং প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। শিশু মৃতু্য-মাতৃমৃতু্যর হার কমেছে। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য বেড়েছে অনেক। এ বৈষম্য ধনী-গরিবের নয়, অঞ্চলে অঞ্চলে। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান হয়নি। সামরিক সরকারগুলো এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতির ধারাবাহিকতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এগুলোকে চেক দিতে না পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাশেদ খান মেননের প্রতি প্রশ্ন ছিল, 'সাহসের সঙ্গে বলতে পারবেন কি সাংগঠনিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনি সৎ রয়েছেন?' সঙ্গে সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে জবাব দেন, মন্ত্রী বা এমপি হিসেবে তিনি অসৎ কোনো কাজ করেননি। তাহলে ভিকারুন্নিসাসহ সংসদীয় আসনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি-বাণিজ্য ও ক্যাসিনো কান্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভর্তি-বাণিজ্যের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করেছে। তারা এর সত্যতা খুঁজে পায়নি। আর ক্যাসিনোর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগই নেই। বিষয়টি তার অজানা। ওয়ার্কার্স পার্টির আগামী কংগ্রেসে নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আসছে কিনা জানতে চাইলে সংগঠনের সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, এবার কংগ্রেসে তরুণ নেতৃত্ব সামনে আসবে। শীর্ষ পদে তিনি আর থাকতে চাইছেন না। তার যে বয়স এখন অবসর দরকার। পরিবারকে সময় দেয়া, লেখালেখি করা ও রিলাক্স করার সময়। কিন্তু সহকর্মীরা তাকে ছাড়তে চাইছে না। দেখা যাক কংগ্রেস কী সিদ্ধান্ত নেয়।