সাড়ে ৫ বছরেও স্বচ্ছ পানির দেখা মেলেনি হাতিরঝিলে

পানি শোধনে আসছে ৫০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

ফয়সাল খান
রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি পচে অন্য রং ধারণ করেছে। এ থেকে ছড়াচ্ছে তীব্র দুগর্ন্ধ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে তা সহ্য করতে হয় Ñবিডিনিউজ
নান্দনিক সাজে সজ্জিত রাজধানীর হাতিরঝিলের প্রকল্প উদ্বোধনের সাড়ে পঁাচ বছর পরও স্বচ্ছ পানির দেখা পাননি দশর্নাথীর্রা। বরং কাজের ফঁাকে ঘুরতে আসা বা যানজট এড়াতে ঝিলের সহজ রাস্তা ব্যবহারকারীদের বরবরই পানির তীব্র দুগর্ন্ধ সহ্য করতে হচ্ছে। এ দুগর্ন্ধ দূর করতে প্রকল্পের শুরু থেকে এ পযর্ন্ত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোটাই সফল হয়নি। ফলে হাতিরঝিলের নিরিবিলি পরিবেশ আর শীতল বাতাসে গা জুড়াতে হলে দুগর্ন্ধ সহ্য করার কোনো বিকল্প নেই। তবে পানি শোধনের জন্য ৫০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ সমস্যা আর থাকবে না বলে দাবি করেছে হাতিরঝিল কতৃর্পক্ষ। সাড়ে পঁাচ বছর আগে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি এ প্রকল্পের নিমার্ণ কাজ শেষে উদ্বোধন করা হলেও স্বচ্ছ পানির দেখা পাননি বলে অভিযোগ করেন হাতিরঝিল এলাকায় ঘুরতে আসা দশর্নাথীর্ ও পাশ^র্বতীর্ এলাকার বাসিন্দারা। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নিমার্ণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে এই প্রকল্পের। অথচ কতৃর্পক্ষের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার কারণে আশপাশের এলাকার পচা-আবজর্না ঝিলের মধ্যে প্রবেশ করে বছরের পর বছর ধরে নষ্ট করছে ঝিলের পানি। পানির স্বাভারিক রঙ বদলে কালচে ও সবুজ রঙ ধারণ করেছে। সে সঙ্গে ছড়াচ্ছে দুগর্ন্ধ। তাছাড়া হাতিরঝিলে যে কয়টি পানি ঢুকার পথ রয়েছে একটি ছাড়া প্রায় সবগুলোই শোধন ক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে আশপাশের এলাকার বজর্্যসহ সবকিছুই প্রবেশ করছে। ঝিলের তলাদেশ দিয়ে বেশ কয়েটি ড্রেনের মাধ্যমে আশপাশের এলাকার বজর্্য মিশ্রিত পানি ঢুকে ঝিলের পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ফলে প্রায় সারা বছরই পানিতে কমবেশি দুগর্ন্ধ হচ্ছে। রাস্তায় তীব্র যানজট আর ঘনঘন সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের ফঁাকে একটু খোলা বাতাসে আড্ডা দেয়া বা ঘুরে বেড়ানোর জায়গা এই নগরীতে খুবই অপ্রতুল। এর মধ্যে হাতিরঝিলের নান্দনিক সৌন্দযর্ দশর্নাথীদের মুগ্ধ করেছে। ছুটির দিন বা অবসর পেলেই ঝিলের পাড়ে বেড়াতে চলে আসেন অনেকেই। ইট-পাথরের নগর জীবনের ব্যবস্তা ভুলে একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসেন অনেকেই। তাদের একজন মধ্য বয়সী এক ব্যাংক কমর্কতার্ আমিনুর রহমান। প্রকল্পের উদ্বোধনের পর থেকে কখনো স্বপরিবারে, কখনো বন্ধুদের নিয়ে আবার কখনোবা একা একা ঝিলের পাড়ে ঘুরতে আসেন। আলাপকালে তিনি জানান, প্রায়ই পানিতে দুগর্ন্ধ থাকে। কখনো কম আবার কখনো বেশি। প্রকল্পের উদ্বোধনের পর থেকে নিয়মিতই ঝিলের পাড়ে আড্ডা দেন। শুরুতে এত গন্ধ ছিল না। এ পযর্ন্ত ঝিলে কখনো স্বচ্ছ পানি দেখতে পাননি। বরং উটকো দুগের্ন্ধ বিরক্ত হয়েছেন বারবার। এ দুগর্ন্ধ না থাকলে ঝিলের পাড়ে বেড়াতে আরও ভালো লাগত। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়া যেত বলে জানান তিনি। এদিকে যানজটময় রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থায়ও হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সাভির্স কিংবা ওয়াটার ট্যাক্সি সবর্ মহলে প্রসংশিত হয়েছে। কিন্তু পানির দুগের্ন্ধর কারণে এসব পরিবহনে যাতায়াতের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে পানির দুগের্ন্ধর কারণে ওয়াটার ট্যাক্সির যাত্রী কমতে শুরু করেছে। অনেক সময় নাক চেপে বসে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকেই। মগবাজার থেকে প্রতিদিন গুলশানে অফিস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী রনি আহমেদ। তিনি জানান, সড়ক পথে দীঘর্ যানজটের কারণে সম্প্রতি ওয়াটার ট্যাক্সি দিয়ে যাতায়াত করেন। এতে যানজট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি ঝিলের পানিতে ভেসে বেড়ানোর আনন্দও উপভোগ করা হয়। কিন্তু বষার্ শেষ হলেই পানির তীব্র গন্ধে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়ে। আগের মতো যাত্রীদের ভিড়ও থাকে না। পযার্প্ত সংখ্যক যাত্রী না হলে দীঘর্ক্ষণ বসে থাকতে হয়। পানির দুগর্ন্ধ আর অপেক্ষার যন্ত্রণায় এখন আর ওয়াটার ট্যাক্সিতে যেতে চান না তিনি। গত শুক্রবার হাতিরঝিলের ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়েন আরিয়ান আবরার। গন্তব্য গুলশান। ছুটির দিনে বন্ধুকে নিয়ে শখের বসে ওয়াটার ট্যাক্সিতে তার প্রথম ওঠা হলেও বিরক্ত নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পানির উৎকট গন্ধ তাদের পুরো জানির্র গল্প হয়ে ওঠে। তার ভাষ্যে, পানির দুগের্ন্ধ পুরো আনন্দ মাটি হলো। আরিয়ানের মতো স্বচ্ছ পানির বুকে ভেসে বেড়ানোর আনন্দ পেতে ওইদিন ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়েছিলেন আরেক ভ্রমণপিয়াসী তরিকুল ইসলাম। বাড্ডার এ বাসিন্দা নিয়মিত হাতিরঝিলের ‘চক্রাকার বাস’ দিয়ে যাতায়াত করেন। তবে শখের বসে সেদিন দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হাতিরঝিলের পানির দুগর্ন্ধ ঠেকাতে তারা নাকে কাপড় চেপে রেখেছিলেন। তাই ভালো করে হাতিরঝিলের সৌন্দযর্ উপভোগ করতে পারেনি তারা। তাদের মতো অনেক দশর্নাথীর্র মধ্যেই পনির দুগর্ন্ধ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাতিরঝিলের এফডিসি মোড় অংশ থেকে লেকের মধুবাগ ব্রিজ পযর্ন্ত পানির রঙ কালচে আর সবুজ বণের্র। সে সঙ্গে রয়েছে ভয়াবহ দুগর্ন্ধ। তাছাড়া ঝিলের পানিতে দশর্নাথীের্দর ফলের খোসা এবং চানাচুর ও চিপসের প্যাকেট ভাসতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, বৃষ্টিতে বাইরের এলাকার শিল্প বজর্্য ভেসে আসে। প্রকল্পের চারপাশে গড়ে ওঠা ছোট-বড় অনেক দোকান ও রেস্তোরঁার ময়লা-আবজর্নাও পানিতে ফেলা হয়। সে সঙ্গে কতৃর্পক্ষের উদাসীনতার কারণে লেকের পাড় ঘেঁষে জমানো ময়লার স্তুপ থেকেও প্রতিদিন দুগর্ন্ধ ছড়াচ্ছে। আর তার খেসারত দিচ্ছেন পথচারী, দশর্নাথীর্ এবং আশপাশের বাসিন্দারা। তবে এফডিসির অংশের লেকের প্রবেশমুখেই আবজর্নার স্তুপ ও মনুষ্য মলমূত্রের দুগর্ন্ধ তুলনামূলক বেশি। পানির রঙ সচরাচর স্বাভাবিক বা স্বচ্ছ দেখেন না আশপাশের বাসিন্দারা। কখনো কালো কুচকুচে বা সবুজ রঙের পানি থেকে প্রায়ই দুগর্ন্ধ আসতে থাকে। অন্যদিকে তিন মাস আগে পানির দুগর্ন্ধ রোধ ও ময়লা শোষণ করতে ঝিলের পানিতে ভাসমান ট্রে তৈরি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। পরীক্ষামূলক এ কাযর্ক্রমটি এফডিসির অংশে করা হলেও কাক্সিক্ষত ফল পেলে পুরো লেকজুড়েই ভাসানোর পরিকল্পনা ছিল কতৃর্পক্ষের। তবে এতে কাক্সিক্ষত ফল না পাওয়ায় ঝিলের পানির দুগর্ন্ধ রোধ এবং পরিশোধনের জন্য নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে হাতিরঝিল প্রকল্প কতৃর্পক্ষ। তাছাড়া প্রকল্পের শুরু থেকে পানি শোধন ও দুগর্ন্ধ দূর করতে নানা কাযর্ক্রম পরিচালনা করলেও সুফল মেলেনি। নাম প্রকাশ না করার শতের্ হাতিরঝিল প্রকল্পের এক কমর্কতার্ জানান, নিমার্ণ কাজের সময় বিভিন্ন সেবা সংস্থা যে যার কাজ সম্পন্ন করলেও ওয়াসা কতৃর্পক্ষ হাতিরঝিলে পানি প্রবেশের সব পথ পয়োবজর্্যমুক্ত করতে আলাদা পয়োনালা নিমার্ণ করেনি। যার কারণে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও পানি নিয়ে অস্বস্তিতে সবাই। এ প্রসঙ্গে আলাপকালে হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের (রাজউক) তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী জামাল আক্তার ভুঁইয়া যায়যায়দিনকে বলেন, হাতিরঝিলের সঙ্গে মহাখালী, মগবাজারের টঙ্গী ডাইভারশন রোড, মধুবাগ, বেগুনবাড়ি, নিকেতন, তেজগাঁও, বাড্ডা ও রামপুরায় এলাকায় দশটি সংযোগ আছে। যেগুলো দিয়ে আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানিসহ ময়লা পানি, পয়োবজ্যর্ ও শিল্পবজ্যর্ এসে পড়ছে ঝিলে। তাছাড়া পান্থপথ, কাওরানবাজার ও কাঁঠালবাগান এলাকার পানির ড্রেন ও স্যুয়ারেজ লাইন একসঙ্গে যুক্ত থাকায় ওইসব এলাকার শিল্প বজ্যর্, বাসাবাড়ির ময়লা পানিসহ সব ধরনের পচা-বাসি পানি হাতিরঝিলের পানিতে মিশছে। ফলে ঝিলের পানিও স্বচ্ছতা হারাচ্ছে। বষার্য় পানির দুগর্ন্ধ আরও প্রকট হয়ে ওঠে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুগর্ন্ধ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পরিশোধনের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য গৃহায়ণ ও গণপূতর্ মন্ত্রণালয়ে ৫০ কোটি টাকার নতুন একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা করেছে রাজউক। হাতিরঝিল প্রকল্প কমর্কতার্ মেজর সাদিক শাহরিয়ার বলেন, হাতিরঝিলের পানির দুগর্ন্ধ রোধে ইতোমধ্যে ঝিলের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। এসব গাছের মধ্যে কলাবতী ও ঘাসজাতীয় গাছের সংখ্যা বেশি। কাক্সিক্ষত ফল পেলে লেকজুড়েই ভাসানো হবে এসব গাছ। পাশাপাশি পানির দুগর্ন্ধ রোধ এবং পরিশোধনের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পযাের্য় রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে পানি পরিশোধনের কাজ শুরু হবে।