নেতা নির্বাচনে আওয়ামী লীগে গোয়েন্দা নির্ভরতা

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশেই আ'লীগ এবং এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনে অন্য দল থেকে অনুপ্রবেশের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে

প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
শিবির সন্দেহে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার পর খুনি হিসেবে চিহ্নিত ছাত্রলীগের ১১ নেতার আদ্যপান্ত খুঁজতে গিয়ে বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, এদের অন্তত তিনজন জামায়াত পরিবারের সদস্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল আরও একজনের। অথচ তারা কীভাবে বুয়েট ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন, এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য কারও কাছেই নেই। এমনকি তাদের নেতা নির্বাচিত করতে কে বা কারা সুপারিশ করেছিলেন; কোন যোগ্যতায় তাদের বুয়েট ছাত্রলীগের হল কমিটিতে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল তাও অজ্ঞাত। একইভাবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুমের আপন ভায়রা হারুন অর রশিদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। যিনি গত সংসদ নির্বাচনেও ভায়রার পক্ষে স্বস্ত্রীক নির্বাচনী প্রচারণার নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সময় বাড্ডা থানা পুলিশের হাতে আটক হন। ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুলস্নাহ আল-মামুন ২০০৫ সালে একটি সিএনজি অটোরিকশা পোড়ানোর ঘটনায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের নামে মামলা [মামলা নং-৫৬(৫)] করে সে সময় বিএনপির আলোচিত নেতা হয়ে ওঠেন। অথচ সম্প্রতি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতিই তাকে তার কমিটির প্রচার সম্পাদক পদ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করেছেন। একইভাবে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ১নং ওয়ার্ডের সভাপতি তাজউদ্দিন তাজুকে সংশ্লিষ্ট থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশেই আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনে জামায়াত-শিবির-বিএনপি ও ফ্রিডম পার্টির স্বক্রিয় নেতাকর্মীর এ ধরনের অনুপ্রবেশের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। যার বেশির ভাগই প্রথম সারির নেতাদের তদবিরে ঘটেছে। এতে কোথাও কোথাও স্বাধীনতার পক্ষশক্তির সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যা ক্ষমতাসীন এ দলটিকে ভীষণভাবে নড়বড়ে করে তুলেছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে আগামী কাউন্সিলে তৃণমূলের নেতা নির্বাচনে মহানগর ও জেলা পর্যায়ের স্থানীয় নেতাদের সব প্রস্তাব ও সুপারিশ উপেক্ষা করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলেও নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্যের নির্ভরতা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাড়ানো হয়েছে। এমনকি দলের প্রভাবশালী জনপ্রিয় নেতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-দুর্নীতিসহ বিতর্কিত কোনো কর্মকান্ডে জড়িত থাকার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সংযুক্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়া গেলে তাকেও গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড এ বিষয়টি নিঃসংকোচে স্বীকার করেছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে জামায়াত-শিবির-ফ্রিডম পার্টি কিংবা বিএনপির স্বক্রিয় নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ এবং অদক্ষ-অযোগ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত করার বিপুলসংখ্যক ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর নেপথ্যে সুযোগসন্ধানী নেতারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তারা নিজ স্বার্থ হাসিল করতেই বিতর্কিত ব্যক্তিদের দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দিয়েছেন। এছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে রাতারাতি পলিটিক্যাল গডফাদার বনে যাওয়ার প্রবণতায় ও দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোণঠাসা রাখতে প্রভাবশালী অনেক নেতা বহিরাগত সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজদের দলে ঠাঁই করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের যেসব নেতার বৈধ-অবৈধ বিপুল অর্থ-সম্পদ ও বাণিজ্য রয়েছে, আওয়ামী লীগের স্বার্থান্বেষী অনেক নেতা তা মিলেমিশে ভোগ করতে তাদের দলে ভিড়িয়েছেন। পাশাপাশি আগামীতে দল ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে নিজেদের অর্থ-সম্পদ নিয়ে তারা যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারেন- এ টার্গেটে অনেকে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে বহিরাগত অযোগ্য ব্যক্তিকে পদ দিয়েছেন। কোনো কোনো নেতা আবার স্রেফ টাকার বিনিময়ে দলের পদ-পদবি বিক্রি করেছেন। অথচ নেতার দাপটের কারণে সেখানকার অন্য নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। কদাচিত দু'একজন কর্মী নেতার এ ধরনের কর্মকান্ডের বিরোধিতা করলে তাকে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অথচ তার এ প্রতিবাদের কণ্ঠ কোনোভাবেই দলীয় হাইকমান্ডের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির এক নেতা জানান, দলীয় নেতাদের এ ধরনের স্বার্থান্বেষী কর্মকান্ডের কারণে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যার বাস্তবায়ন এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এ ধারা শুধু আগামী কাউন্সিল পর্যন্তই নয়, স্বার্থান্বেষী নেতাদের মানসিকতার আমূল পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তা চলবে বলে দাবি করেন প্রবীণ ওই নেতা। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক মাসে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের যে আমলনামা সংগ্রহ করা হয়েছে তাতে দলে বহিরাগত সন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজদের অনুপ্রবেশ এবং অদক্ষ-অযোগ্য নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দেওয়ার যে ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে, বিগত সময় স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া বিতর্কিত নেতাদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য সংগ্রহ করে সে সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে গোয়েন্দারা অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। অথচ বিগত সময় নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে বহিরাগতদের কাছে পদ বিক্রিসহ বিভিন্ন মৌখিক অভিযোগ দিলেও তা ছিল তথ্য-উপাত্তহীন। গুরুতর কোনো অভিযোগেরও সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ থাকত না। যে কারণে অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের আমলনামা সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, তথ্য সংগ্রহকারী গোয়েন্দাদের দলীয় পদ-পদবি প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা কিংবা সুযোগ যেমন নেই, তেমনি প্রভাবশালী নেতার গোপন তথ্য হাইকমান্ডকে অবহিতকরণের ক্ষেত্রেও হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হওয়ার কোনো ভয় নেই। ফলে তারা যে কোনো দাপুটে নেতার ছোট-বড় অপকর্মের তথ্য নির্ভয়ে দলীয় হাইকমান্ডকে জানাতে পারছে। অন্যদিকে প্রশাসনে গোয়েন্দাদের সহজ 'একসেস' থাকায় তারা স্বল্প সময়েই প্রভাবশালী নেতার যে কোনো দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারছেন। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত প্রমাণাদি যোগাড় করার সুযোগ রয়েছে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ নেতাকর্মীদের পক্ষে সম্ভব নয়। নেতাদের কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা থাকলে ওই মামলার চার্জশিটসহ আনুষঙ্গিক নথি সংগ্রহ এবং মামলার বর্তমান অবস্থান জানা গোয়েন্দাদের পক্ষে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই সহজ। এছাড়া গোয়েন্দাদের পক্ষে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো নেতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-দুর্নীতি কিংবা অন্য কোনো অপকর্মের অভিযোগ আনার তেমন কোনো সুযোগ নেই। কেননা গোয়েন্দাদের এ ধরনের প্রতিটি তথ্য 'ক্রসচেক' করে দেখা হচ্ছে। নেতাদের বিরুদ্ধে ভুল কিংবা মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা থাকায় তারা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকছেন। অথচ স্থানীয় পর্যায়ের এক নেতার বিরুদ্ধে অন্য নেতার ঢালাও অভিযোগের অসংখ্য নজির রয়েছে। বিশেষ করে দলে অনুপ্রবেশকারীদের সম্পর্কে নানা অভিযোগ উত্থাপনের ক্ষেত্রে বরাবরই প্রতিদ্বন্দ্বী দু'পক্ষই এগিয়ে থাকছে। ফলে মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনে দলীয় হাইকমান্ড অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ নব্য আওয়ামী লীগারদের দাপটে সারাদেশে মূল স্রোতের আওয়ামী লীগাররাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে এখন বিএনপি-জামায়াত ও ফ্রিডম পার্টির নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশকিছু জটিলতা থাকলেও দলীয় হাইকমান্ড তাতে যথেষ্ট আস্থাশীল। কেননা এতে অন্তত দুর্নীতিবাজ নেতারা মিথ্যা অভিযোগ তুলে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে রাখতে পারবেন না। একই সঙ্গে জামায়াত-শিবির-ফ্রিডম পার্টির ক্যাডারদের পক্ষে ভুয়া প্রশংসার সনদ দিয়ে দলে অনুপ্রবেশের ধারায় বড় ধরনের ছেদ পড়বে। স্বল্প সময়ের মধ্যে গোয়েন্দারা রাজনৈতিক গডফাদারদের সব তথ্য সংগ্রহ করতে না পারলেও শিগগিরই এ সংকট কেটে যাবে বলে আশাবাদী আওয়ামী লীগের এই দায়িত্বশীল নেতা। প্রসঙ্গত, বিএনপি ও জামায়াত-শিবির ছেড়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী চারদলীয় জোটের সহিংস আন্দোলন দমে যাওয়ার পর এই অনুপ্রবেশ তীব্র স্রোতে রূপ নেয়, যা এখন আওয়ামী লীগের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।