বিদু্যতের দাম বাড়াতে ২৮ নভেম্বর থেকে গণশুনানি

প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বিদু্যতের দাম বাড়াতে সঞ্চালন ও বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব পেয়ে গণশুনানির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ছয় মাসের মধ্যেই বিদু্যতের দাম বাড়ানোর আবেদন জমা পড়ে বিইআরসিতে। আগামী ২৮ নভেম্বর থেকে শুরু হবে তা নিয়ে গণশুনানি। বিদু্যতের দাম বাড়াতে পরিচালন ও জনবল বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন ও সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়েছে কোম্পানিগুলো। বিতরণকারী বা খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডেসকো, ডিপিডিসি, ওজোপাডিকো ও নেসকো দাম বাড়ানোর আবেদন করলেও পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাইকারি দাম না বাড়লে তাদের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ও পরিচালন ব্যয় বাড়ার ফলে লোকসানের ফর্দ নিয়ে গত ১৫ অক্টোবর বিইআরসির দ্বারস্থ হয় বিদু্যতের একমাত্র পাইকারি বিক্রেতা বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ওই প্রস্তাব দৃশ্যত দাম বাড়ানোরই প্রস্তাব। আর একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে আরও বেশি হুইলিং চার্জ দাবি করে আবেদন করেছে বিইআরসিতে, যা আরেক ধাপে খুচরা মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। পিজিসিবি বিভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে দাম বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করেছে। বিতরণ সংস্থা ডেসকো ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হারে দাম বাড়াতে চাচ্ছে। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট কোনো দাম প্রস্তাব করেনি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে পাইকারি বিদু্যতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ায় সরকার। আর চলতি বছরের ৩০ জুন গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। গত অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে বিদু্যতের একক ক্রেতা ও পাইকারি বিক্রেতা পিডিবি, সঞ্চালন কোম্পানি পিজিসিবি এবং বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি, ডেসকো, বিআরইবি, ওজোপাডিকো ও নেসকো নিজেদের চাহিদা তুলে ধরে বিইআরসির কাছে আবেদন জমা দিতে থাকে। এসব আবেদন নিয়ে গণশুনানির গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে বিইআরসি। তা অনুসারে আগামী ২৮ নভেম্বর পাইকারি মূল্যহার ও সঞ্চালন মূল্যহার পরিবর্তনের প্রস্তাবের উপর শুনানি হবে। এরপর ১ ডিসেম্বর পিডিবি ও নেসকোর খুচরা মূল্যহার পরিবর্তনের ওপর শুনানি হবে। ২ ডিসেম্বর ঢাকার দুই বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকোর আবেদনের উপর শুনানি হবে। ৩ ডিসেম্বর ওজোপাডিকো ও পলস্নী বিদু্যতের প্রস্তাবের উপর শুনানি হবে। পিডিবির হিসাবে আরইবি ৪৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ বিদু্যৎ বিতরণ করে। এছাড়া পিডিবি ১৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ডিপিডিসি ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ডেসকো ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, নেসকো ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ওজোপাডিকো ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ বিদু্যৎ বিতরণ করে থাকে। বিদু্যৎ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবে যে কারণ দেখানো হয়েছে, তাকে 'অযৌক্তিক' বলছেন ভোক্তা অধিকার রক্ষার নাগরিক সংগঠন কনজু্যমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, 'কোম্পানিগুলোর পরিচালন ব্যয় ও দুর্নীতি কমানোর পথগুলো আগেও দেখিয়েছি। এই ইসু্যতে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব অযৌক্তিক।' 'পাইকারিতেও দাম বৃদ্ধির সুযোগ নেই, তবুও প্রস্তাব করা হয়েছে। আর ২০১৫ সালে হুইলিং চার্জ ১৮ পয়সা বাড়িয়ে ধরা হয়েছিল। শুনানিতে আমরা এসব প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরব,' বলেন তিনি। পিডিবির প্রস্তাব : পাইকারি বিদু্যতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে পিডিবি বলেছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে বিদু্যৎ খাতের জন্য গ্যাসের দাম ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়। ফলে গ্যাস জ্বালানি বাবদ ২০২০ সালে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে। এছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্রে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় তার ব্যয়ও বাড়বে। গত ১৫ অক্টোবর পাইকারিতে মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করার দুদিন পর খুচরা পর্যায়েও মূল্য বৃদ্ধির আবেদন জমা দেয় পিডিবি। বিদু্যতের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া ও পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পাইকারিতে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিলস্না, সিলেট, ময়মনসিংহ জেলায় পিডিবির বিতরণ ব্যবস্থা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাল্ক ট্যারিফ সমন্বয় পাস থ্রম্ন এবং চলতি খুচরা ট্যারিফ বিবেচনায় পিডিবির জোনগুলোতে খুচরা গ্রাহকের এনার্জি চার্জ, ডিমান্ড ও সার্ভিস চার্জ সমন্বয় করে খুচরা দর জানুয়ারি থেকে সমন্বয় প্রয়োজন বলে প্রস্তাব দিয়েছে তারা। প্রস্তাবে উলেস্নখ করা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পিডিবি বিতরণের জন্য বিদু্যৎ কিনেছিল ১১ হাজার ৪০০ দশমিক ২২ মিলিয়ন ইউনিট। খুচরা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করেছে ১০ হাজার ৫৭২ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ইউনিট। এই ক্ষেত্রে সিসটেম লস ছিল ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২০ সালে ১৩ হাজার ৪৬৯ মিলিয়ন ইউনিট কেনার প্রাক্কলন করা হয়েছে। ১২ হাজার ৯২৪ মিলিয়ন বিক্রির পরিকল্পনা আছে। অর্থাৎ সিসটেম লস ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। পিজিসিবি : গত ২০ অক্টোবর বিইআরসিতে সঞ্চালন চার্জ বাড়ানোর আবেদন জানায় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এতে বলা হয়, ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর সঞ্চালন ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়ছিল। ইতোমধ্যে চার বছর অতিক্রম করায় সঞ্চালন ট্যারিফ পুনরায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে সঞ্চালন চার্জ ২৩০ কেভি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট শূন্য দশমিক ২৭৪৪ টাকা, ১৩২ কেভি লেবেলে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ২৭৬৮ টাকা, ৩৩ কেভিতে লেবেলে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ২৭৯১ টাকা রয়েছে। নতুন করে আগামী জানুয়ারি থেকে বর্তমানে সঞ্চালন চার্জ ২৩০ কেভি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট শূন্য দশমিক ৪১৬৬ টাকা, ১৩২ কেভি লেবেলে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ৪২০২ টাকা, ৩৩ কেভি লেবেলে প্রতি ইউনিট সঞ্চালন চার্জ শূন্য দশমিক ৪২৩৭ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নেসকো : ২০১৬ সালের অক্টোবরে পিডিবির রাজশাহী-রংপুরের বিতরণ অঞ্চল নিয়ে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপস্নাই কোম্পানির (নেসকো) যাত্রা শুরু। সংস্থাটির মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলা হয়, অধিকাংশ গ্রাহক আবাসিক, সেচ ও ক্ষুদ্র শিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ধরনের গ্রাহকের বিলিং রেট অত্যন্ত কম। বর্তমান খুচরা ট্যারিফ অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সালের গড় ট্যারিফ ৬ টাকা ৬০ পয়সা। ফলে তাদের প্রতি ইউনিটে ১৬ পয়সা লোকসান। এটা সমন্বয় প্রয়োজন। তা সম্ভব না হলে বাল্ক ট্যারিফের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আনুপাতিক হারে মূল্যহার পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। নেসকোর কাছে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৯৮ পয়সা পাইকারি দামে বিদু্যৎ বিক্রি করছে পিডিবি। এর সঙ্গে কোম্পানির বিতরণ ব্যয় রয়েছে ১ টাকা ১৫ পয়সা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই ব্যয় শূন্য ৬ পয়সা বেড়ে ১ টাকা ২১ পয়সা এবং ২০২০ পঞ্জিকা বছরে বেড়ে ১ টাকা ৩১ পয়সায় দাঁড়াবে বলে দাবি করছে নেসকো। এই প্রাক্কলিত বিতরণ ব্যয় বিবেচনায় নিতে গত ২০ অক্টোবর সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। ওজোপাডিকো :খুলনা-বরিশাল অঞ্চলের বিতরণকারী সংস্থা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) গত ২১ অক্টোবর আবেদন জমা দেয়। তাতে বলা হয়, ইতোমধ্যেই ওজোপাডিকোর বিতরণ ব্যয় বেড়েছে। জনবলের বেতন-ভাতা ও কিছু প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের সুদ বাবদ বিতরণ ব্যয় বেড়েছে। তাই নতুন করে এই ব্যয় সমন্বয় করে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এছাড়া পাইকারি পর্যায়ে বৃদ্ধি পেলে ওজোপাডিকোর খুচরা মূল্য হার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ডিপিডিসি : গত ২২ অক্টোবর বিইআরসিতে প্রস্তাব জমা দেয় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। এতে বলা হয়, ট্যারিফ বিতরণ রেট ইউনিট প্রতি ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। কিন্তু গত দুই বছরে ডিপিডিসির জনবল, অবচয় ও সম্পদের পরিবৃদ্ধি, অপারেশন অ্যান্ড মেনটেন্যান্স এবং ফিন্যান্সিয়াল ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বিতরণ রেট পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। রেটবেজ বিবেচনায় চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪৮ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা, এবং ২০২০ পঞ্জিকা বছরে ১৮৩ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা নিট রাজস্ব দরকার হবে। এসব পরিপ্রেক্ষিতে ডিপিডিসির খুচরা বিদু্যতের মূল্যহার পরিবর্তনের আবেদন করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা ১৮৪ কোটি টাকার রাজস্ব চাহিদা সমন্বয় করতে চাচ্ছে। পাশাপাশি পিডিবি বাল্কে দাম বাড়ালে সেটা পস থ্রম্ন পদ্ধতিতে সমন্বয়ের প্রস্তাব জানিয়েছে। ডেসকো :২২ অক্টোবর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় ঢাকা ইলেকট্রিক সাপস্নাই কোম্পানি (ডেসকো)। এতে বলা হয়, বেতন ভাতা বৃদ্ধি, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি, বৈদু্যতিক সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধি, সর্বোপরি মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডিপিডিসি ক্রমেই আর্থিক সক্ষমতা হারাচ্ছে। তাই বর্তমানে ক্রয় করা বিদু্যতের মূল্য হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে ডেসকোর গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা মূল্য হার ৫ দশমিক ০৬ শতাংশ হারে বাড়ানো প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে পাইকারি মূল্যের সঙ্গে ডেসকোর খুচরা মূল্যের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে বলেও দাবি করা হয় আবেদনে। '২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পাইকারি মূল্য ২১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ বাড়লেও খুচরা বিক্রয় মূল্য বেড়েছে ৯৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। ফলে কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ২০১৭ সালে আবাসিক গ্রাহকদের ছয়টি ধাপে ক্রয় মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রির নির্দেশ ছিল। ওই ধাপগুলোর ব্যবহারকারী প্রায় ৪০ শতাংশ। এই কারণে ক্রয় মূল্যের চেয়ে ইউনিট প্রতি এক টাকা ১২ পয়সা লোকসানে বিক্রি করতে হয়েছিল, বলা হয় আবেদনে। এছাড়া প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি, অটোমেশন ও ডিজিটাইজেশন ব্যয়, বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের প্রসঙ্গ উলেস্নখ করা হয়েছে আবেদনে। পলস্নী বিদু্যৎ :গত ২১ অক্টোবর তাদের প্রস্তাব দেয় পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ড। পিডিবির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাইকারি মূল্যহার বাড়ানো হলে সেই অনুযায়ী তাদের মূল্য সমন্বয়ের আবেদন করে রেখেছে তারা। তারা বলেছে, ২০১৭ সালে নতুন ট্যারিফ কার্যকর হওয়ার পরও পলস্নী বিদু্যৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্রেক ইভেনে ছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ব্রেক ইভেনে থাকছে। এখন কমিশন নতুন করে বিদু্যতের পাইকারি মূল্যহার বাড়ালে পলস্নী বিদু্যৎ সমিতিগুলোর খুচরা মূল্যও বাড়াতে হবে।