উপকূলে বুলবুলের তান্ডব

প্রকাশ | ১০ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ঘূর্ণিঝড় 'বুলবুল'-এর প্রভাবে সাগর উত্তাল, ঝরছে বৃষ্টি। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ছুটছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। ছবিটি শনিবার খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার ফেরিঘাট এলাকা থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা
ধারণা করা হচ্ছিল শনিবার সন্ধ্যায় আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল; তবে মধ্যরাত নাগাদ এটি তান্ডব চালিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করে। আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান বলেন, 'রাত ১০টা থেকে ঘূর্ণিঝড়ের বর্ধিতাংশ উপকূলীয় এলাকায় প্রবেশ করে। ঘূর্ণিঝড়টির ব্যাস ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। মূল কেন্দ্রের ব্যাসও প্রায় ২০ কিলোমিটারের মতো।' আবহাওয়াবিদ আয়েশা খানম বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়টি যে বডি মুভ করছে, সেটার গতিবেগ ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মতো। ঘূর্ণিঝড় উপকূলের কাছাকাছি যখন আসে, তখন সামনে যে ওর যে বডি মুভমেন্ট, তা কখনো স্স্নো, কখনো বেড়ে যায়।' গতিচিত্র অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র উপকূলে ওঠে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে, এরপর এটি স্থলভাগের ওপর দিয়ে সাতক্ষীরা হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। আয়েশা বলেন, 'যখন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে, তখন দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ১০০ কিলোমিটার থেকে ১২০ কিলোমিটার।' বুলবুল অতিক্রমের সময় সাগরে জোয়ার ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৭ ফুট বেশি উঁচু। জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল এই জলোচ্ছ্বাসে পস্নাবিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বৃষ্টি ঝরেছে; আবহাওয়ায় রয়েছে অনেকটা গুমোট ভাব, যা আইলার কথা মনে করিয়ে দেয় উপকূলবাসীকে। ১০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও সুন্দরবন এলাকায় আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। সেই ঝড়ের শক্তি ছিল বুলবুলের মতোই। আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, 'বাতাসের গতিবেগ ছিল অনেক। তবে সুন্দরবন অনেকটাই প্রোটেক্ট করে।' এর আগে ঝড় মোকাবিলায় সার্বিক প্রস্তুতি নেয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ। উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার ১৮ লাখ মানুষকে সন্ধ্যার আগেই চার হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। মহাবিপৎসংকেত জারির পর সমুদ্রবন্দরগুলোতে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়; অভ্যন্তরীণ নৌপথেও চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শনিবার সকালেই বাগেরহাটের মোংলা ও পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়। তবে কক্সবাজারে আগের মতোই চার নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত বহাল রয়েছে। উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের আওতায় রাখা হয়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর, ফেনী, চাঁদপুর থাকবে ৯ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায়। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। ঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে মোংলা, চট্টগ্রামসহ সব সমুদ্রবন্দরে কাজ বন্ধ রাখা হয়। সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলে অভ্যন্তরীণ নৌপ?রিবহণ কর্তৃপ?ক্ষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সার্বিক প্রস্তুতির তথ্য নিয়ে শনিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন। তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে ৩ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।' সন্ধ্যার আগেই ১৮ লাখ মানুষকে চার হাজার ৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিপ্তরের মহাপরিচালক শাহাদৎ হোসেন সকালে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ সাত জেলাসহ যেসব জেলা দুর্যোগপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো থেকে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করে প্রস্তুতি সাজানো হয়েছে। বলার পরও যারা আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন না, তাদের নিতে বাধ্য করতে পুলিশ নামানো হয়েছে বলে জানান পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার ও জরুরি ত্রাণ তৎপরতার জন্য। পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ২০০০ প্যাকেট করে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকে এবং ২২টি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করছেন। উপকূলীয় ১৩ জেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব জেলার সব কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা গঠন করেছে এক হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের উদ্ভব সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট উষ্ণমন্ডলীয় ঝড় মাতমো গত অক্টোবরের শেষে ভিয়েতনাম হয়ে স্থলভাগে উঠে আসে। সেই ঘূর্ণিবায়ুর অবশিষ্টাংশই ইন্দোনেশিয়া পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে এসে আবার নিম্নচাপে রূপ নেয়। বার বার দিক বদলে নিম্নচাপটি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে এসে বুধবার রাতে তা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। তখন এর নাম দেওয়া হয় বুলবুল। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দপ্তরের নির্ধারিত তালিকা থেকে ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলের ঝড়ের নাম দেওয়া হয়। বুলবুল নামটি নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে।