বিমানে প্রথম চালান ঢাকায় পৌঁছবে মঙ্গলবার পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ

পেঁয়াজের ঝাঁজে নিম্নবিত্তের কান্না

সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা। এর মধ্যে শেষ চার দিনের প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা করে বেড়েছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে শনিবার পেঁয়াজের কেজি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় পৌঁছেছে

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। হু হু করে দাম বেড়ে নিত্যপণ্যটি এখন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বাধ্য হয়ে রাজধানীর বিশাল একটি অংশ কম দামে পেঁয়াজ কিনতে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) ট্রাকে ভিড় করছেন। শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা। এর মধ্যে শেষ চার দিনের প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা করে বেড়েছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে শনিবার পেঁয়াজের কেজি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় পৌঁছেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বলেছেন, 'পেঁয়াজ বিমানে উঠে গেছে। কার্গো বিমান ভাড়া করে পেঁয়াজ আনা হচ্ছে। কাল-পরশু পেঁয়াজ এলে দাম কমে যাবে।' তিনি আরও বলেন, 'যাদের কারণে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে বা দাম বেড়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।' শনিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মিসর থেকে কার্গো বিমানযোগে আমদানি করা পেঁয়াজের প্রথম চালান ঢাকায় পৌঁছাবে মঙ্গলবার। এস আলম গ্রম্নপ বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করছে, এটি তার প্রথম চালান। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য আমদানিকারকদের আমদানি করা পেঁয়াজের কার্গো উড়োজাহাজ ঢাকায় পৌঁছাবে। চালানগুলো এলে নিয়ন্ত্রণে আসবে পেঁয়াজের বাজার। এদিকে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আড়তে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রাজধানীর বাজার ঘুরে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেঁয়াজের বাড়তি ঝাঁজ সইতে পারছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। যে কারণে ৪৫ টাকা কেজি দরে টিসিবির পেঁয়াজ কিনতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভিড় করছেন তারা। এক কেজি পেঁয়াজের জন্য কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরপরও হাতে পেঁয়াজ পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন তারা। যেন সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতো। শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর সচিবালয় ও জাতীয় প্রেসক্লাবের মাঝের রাস্তায় টিসিবির ট্রাকে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা যায়। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে থাকেন লাইনে। দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় রোকসানা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পেঁয়াজ নিতে পেরেছি। এরপরও আমি খুশি। কারণ বাজারে পেঁয়াজের যে দাম তাতে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। সকালে বাজারে গিয়ে দেখি এক কেজি পেঁয়াজের দাম ২৬০ টাকা। এখানে সেই পেঁয়াজ ৪৫ টাকা। হিসাব করে দেখেন, এখান থেকে পেঁয়াজ কিনলে কেজিতে ২১৫ টাকা বেঁচে যাচ্ছে।' পেঁয়াজ কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মারুফ হোসেন বলেন, 'দেড় ঘণ্টার বেশি লাইনে দাঁড়িয়েছি। সামনে এখনো ৫০ জনের মতো লোক। জানি না কখন শেষ মাথায় পৌঁছাব। এ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার থেকে বড় কষ্ট পাচ্ছি বাজারে পেঁয়াজের দাম শুনে। এক কেজি পেঁয়াজের দাম ২৭০ টাকা। এটা অনেকটা কাল্পনিক গল্পের মতো। অথচ এটাই এখন বাস্তব চিত্র।' খাদেজা বেগম নামের এক ক্রেতা বলেন, 'ভাই গরিব হয়ে জন্মানো পাপ। তা না হলে কি পেঁয়াজ কিনতে এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! ২৭০ টাকা পেঁয়াজের দাম শুনলে আমাদের চোখে পানি আসে। কিন্তু যাদের টাকা আছে তাদের কিছু হয় না। উল্টো তারা পেঁয়াজের দাম নিয়ে হাসাহাসি করে।' বাজার বা দোকানের অনেক খুচরা বিক্রেতা দু-তিন দিন আগে পেঁয়াজ কিনলেও সকালে বাজার দেখে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অন্যদিকে ক্রমাগত দামের ঊর্ধ্বগতিতে পেঁয়াজ কেনা ও ভোগের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে ভোক্তারা। পেঁয়াজের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিনই দাম বাড়ার কারণে মানুষ পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আগে মোটামুটি সামর্থ্যবান যারা ছিলেন, তারা ৫ কেজির (এক পালস্না) নিচে পেঁয়াজ কিনতেন না। কিন্তু এখন তারা এক কেজির বেশি কেনেন না। আর একপোয়া (২৫০ গ্রাম) পরিমাণ পেঁয়াজ বিক্রির হার অনেক বেড়ে গেছে। উত্তর রায়েরবাগের ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন বলেন, 'আমি গত কয়েক সপ্তাহে একসঙ্গে এক কেজির বেশি পেঁয়াজ কিনেছেন এমন ক্রেতা পাইনি। মানুষ পেঁয়াজ খাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে ১০-২০ টাকারও পেঁয়াজ চায় এখন, বিক্রিও করি। আগে এমন ছিল না।' শনির আখড়া বাজারের সুর্বণা সুইটসের মালিক সুজিত দত্ত বলেন, 'আমাদের ঘরে পেঁয়াজ খাওয়া অনেক কমে গেছে। আগে যেখানে ২ কেজি লাগত এখন সেখানে আধা কেজি দিয়ে পার করছি। এত দাম বেড়ে যাচ্ছে, ব্যবহার কমানো ছাড়া তো আমাদের কোনো উপায় নেই।' মাতুয়াইল কবরস্থান রোডের নুরুল আমিনের বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. ইসমাইল মৃধা বলেন, 'সকাল-বিকাল পেঁয়াজের দাম বাড়ে, এটা কেমন দেশ? মনে হয় কেউ দেখার নেই। কিছু তো করতে পারব না তাই পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। ৫০০ গ্রাম পেঁয়াজ দিয়ে ১০ দিন খাচ্ছি। আগে যেখানে মাসে লাগত ৬ কেজি পেঁয়াজ।' ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকেই দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। দফায় দফায় বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার খবরে ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ১০০ টাকায় পৌঁছে দেশি পেঁয়াজের কেজি। খুচরা পর্যায়ে ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকা কেজি বিক্রি হতে থাকে। এরপর বেশ কিছুদিন পেঁয়াজের দাম অনেকটা স্থির ছিল। ৭০-৮০ টাকা কেজিতে নেমে এসেছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর আবারও পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং আমদানি করা পেঁয়াজ আসছে না- এমন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেন। এতে আবারও ১০০ টাকার ওপরে পৌঁছে যায় পেঁয়াজের কেজি। এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক বক্তৃতায় বলেন, পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামানো সম্ভব নয়। মন্ত্রীর এমন বক্তব্য পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আরও উসকে দেয়। ১০০ টাকা থেকে পেঁয়াজের কেজি ১৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক আছে। পরের দিন পেঁয়াজের কেজি ১৫০ টাকা পৌঁছে যায়। তবে এখানেই থেমে থাকেনি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা। গত বুধবার ১৫০ টাকা থেকে পেঁয়াজের দাম এক লাফে ১৭০ টাকায় পৌঁছে। বৃহস্পতিবার সেই দাম আরও বেড়ে ২০০ টাকায় দাঁড়ায়। সপ্তাহের শেষদিন শুক্রবার তা আরও বেড়ে ২৫০ টাকায় পৌঁছায়। পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা চলতি সপ্তাহেও অব্যাহত রয়েছে। সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবার কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। এর আগে কখনো দেশের বাজারে এত দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়নি। রামপুরার হাসান বলেন, প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। শুক্রবার এক কেজি পেঁয়াজ ২৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। আজ ২৬০ টাকা। কেউ কেউ ২৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। আমাদের কিছু করার নেই, পাইকারিতে প্রতিদিন দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, বুধবার শ্যামবাজার থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনেছি। বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ কিনি ২০০ টাকায়। শুক্রবার শ্যামবাজারে পেঁয়াজের কেজি ছিল ২৩০ টাকা, আর শনিবার তা আরও বেড়ে ২৫০ টাকা হয়েছে। পাইকারিতে প্রতিদিন দাম বাড়লে আমাদের কী করার আছে? পেঁয়াজ নিয়ে সুখবর দিল পাইকাররা এদিকে দামের অপ্রতিরোধ্য যাত্রায় খুচরা বাজারে শনিবার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৬০-২৭০ টাকায়। এ অবস্থায় সুসংবাদ দিল রাজধানীর কারওয়ানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। তারা বলছেন, শুক্রবারের তুলনায় শনিবার পাবনাসহ কয়েকটি জায়গায় পাইকারী বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজিতে ১০ টাকা করে কমেছে। রোববার ঢাকাতেও ১০ টাকা করে কমবে। কারওয়ানবাজারের কয়েকজন পাইকারী ব্যবসায়ী ও আড়তদারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে পাবনা থেকে কারওয়ানবাজারে পেঁয়াজ সরবরাহকারী পাইকারি ব্যবসায়ী নিতাই বাবু বলেন, ' শনিবার পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম ২২০-২৩০ টাকা চলছে। তবে রোববার ঢাকায় পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা কমতে পারে। কারণ শনিবার পাবনায় প্রতিমণে ৩০০-৪০০ টাকা কমে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। পাবনার পেঁয়াজ শনিবার রাতের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাবে, ভোরে এসব পেঁয়াজ বিক্রি করা হবে।' এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারওয়ানবাজারের আড়তদার মমতাজ এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মো. মোস্তফা বলেন, 'পেঁয়াজ কম দামে আমদানি করে সিন্ডিকেট করে মানুষের বিরুদ্ধে হতাশা সৃষ্টি করে। যারা আমদানি করছে তারা ১০ জন আমদানি করলে দুজন বাজারে ছাড়ে। আর বাকি আটজনেই বেশি লাভের আশায় পেঁয়াজ গোডাউনে মজুত করে রাখে।' সরকারকে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান এ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, একজন আমদানিকারক পেঁয়াজ আমদানি করে কেজিতে ৫ বা ১০ টাকা লাভ করতে পারে, এ জন্য সরকার নীতিমালা করে দিলে ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, তবে আশার কথা হচ্ছে শনিবার পাবনাসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় পেঁয়াজের দাম কমেছে। রোববার ঢাকায়ও পেঁয়াজের দাম কমবে। খুচরা বিক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে কম দামে কিনলেও দু-এক দিন আগের বেশি রেটেই বিক্রি করে উলেস্নখ মোস্তফা বলেন, আমাদের কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতারা ২২০ টাকা করে পেঁয়াজ কিনলেও তারা বিক্রি করে ২৬০ টাকা, তাদের আসলে বিক্রি করা উচিত ছিল ২৩০ টাকা। খুচরা বিক্রেতাদের সর্বোচ্চ ১০ টাকা লাভ করা উচিত। কিন্তু তারা অতিরিক্ত লাভ করে।' এ আড়তদার বলেন, 'আমি পাবনা, ফরিদপুর আর রাজবাড়ীর পেঁয়াজ আনি। এসব দেশি পেঁয়াজের দাম একটু বেশি থাকে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কিছুটা কম। আমদানি করা পেঁয়াজ কম দামে আনলেও বাজারে ছাড়ে দেরি করে।' দেশি পেঁয়াজ আর কত দিনের মধ্যে উঠবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে পাতা পেঁয়াজ ওঠা শুরু করেছে। আর এ মাসের শেষের দিকেই পেঁয়াজ ওঠা শুরু করবে। তখন প্রতিদিন কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমতে শুরু করবে।' কারওয়ান বাজারের আরেক আড়তদার মেসার্স মাতৃভান্ডারের মালিক কালাম শেখ বলেন, 'কৃষক পেঁয়াজ ধরে রাখে, দাম উঠলে বিক্রি করে। দেশের বাইর থেকে বেশি বেশি আমদানি করা সম্ভব হলে পেঁয়াজের বাজার এমনিতেই কমে আসবে।' তিনি বলেন, 'যদি আগেই বাণিজ্যমন্ত্রী বিভিন্ন আমদানিকারকের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিত যে, চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ আমদানি করত এবং সে অনুযায়ী যদি আমদানি হতো তাহলে বাজারে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।