দেশব্যাপী আন্দোলনের হুমকি মালিক ও শ্রমিকদের

গণপরিবহণে ফের নৈরাজ্যের শঙ্কা

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
বাস্তবায়ন হয়েছে নতুন সড়ক আইন। সোমবার রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত নতুন আইন কার্যকর তদারকি করে -যাযাদি
কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও ট্রাফিক পুলিশ নতুন সড়ক পরিবহণ আইন বাস্তবায়নে মাঠে নামায় ফের জনগণকে জিম্মি করে গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা এ পথ থেকে সরকারকে পিছু হটাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সড়ক আইন কার্যকরে অভিযান পরিচালনার প্রথম দিন সোমবার তারা কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। এতে সেখানে বিভিন্ন গন্তব্যের গণপরিবহণ যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েন। গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা রাজধানীতে সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাসের কিছুটা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় দিনভর সকাল ও বিকালের পিক-আওয়ারে গণপরিবহণ যাত্রীদের যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। গণপরিবহণ খাতের পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, বিআরটিসির পর্যাপ্ত যানবাহন রাস্তায় নামানোসহ বিকল্প কোনো পথ উন্মুক্ত না রেখেই এ ধরনের বড় উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং তা বানচালে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের পালটা চ্যালেঞ্জে এ খাতে ফের দীর্ঘমেয়াদি নৈরাজ্যের আশঙ্কা রয়েছে। এতে গণপরিবহণে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীদের নানামুখি ভোগান্তির পাশাপাশি যাতায়াত ব্যয়ও বাড়বে। অন্যদিকে আটঘাট না বেঁধে সরকার নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়নে মাঠে নামায় তা বিগত সময়ের পরিবহণ-সংক্রান্ত অন্যান্য অভিযানের মতোই ব্যর্থ হবে। ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা নতুন সড়ক আইন কার্যকরের প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলনে নামতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। যদিও নতুন সড়ক আইন গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা মেনে নিয়েছে বলে তাদের বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা ঢালাও বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের কারো কারো ভাষ্য, নতুন আইন সম্পর্কে শ্রমিকদের কোনো ধারণা না থাকায় তারা কিছুটা হইচই করছে। তবে কদিন পার হলে তা থেমে যাবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উলস্নাহ যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমরা নতুন সড়ক পরিবহণ আইনের পক্ষে। তবে সরকারের কাছে আইনটি ধীরে ধীরে কার্যকর করার অনুরোধ করছি। কারণ নতুন আইনে জেল-জরিমানা অনেক বেশি। তাই সাধারণ চালকদের মধ্যে যাতে আতঙ্ক তৈরি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।' নতুন সড়ক আইন কার্যকরের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস ধর্মঘটের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম একটু-আধটু সমস্যা তো হতেই পারে। এ নিয়ে বাস মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে পরিবহণ মালিক সংগঠনের নেতারা মুখে যা-ই বলুক না কেন এ নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয় তা গণপরিবহণের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। সোমবার আন্তঃজেলা ও নগর সার্ভিসের অন্তত একডজন চালক-হেলপারের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। তারা জানান, নতুন সড়ক আইনে যেভাবে জেল-জরিমানা বাড়ানো হয়েছে, তাতে তাদের রুটি-রুজির ওপর শিগগিরই হাত পড়বে। এ পরিস্থিতিতে তারা জীবন-জীবিকার তাগিদে কঠোর আন্দোলনে নামবে। এ নিয়ে প্রয়োজনে না খেয়ে গোটা পরিবহণ খাত অচল করে দেবে বলে হুঙ্কার দেন তারা। যশোর-খুলনা-বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্তত ১০ জেলার গণপরিবহণ শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকেও একই ধরনের কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতির খবর পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, মালিকরা আন্দোলনের বিপক্ষে থাকলেও শ্রমিকরা এ নিয়ে মাঠে নামলে তাদের তখন কিছুই করার থাকবে না। কারণ শ্রমিকদের বিপক্ষে গিয়ে বিকল্প চালক-হেলপার যোগাড়ের কোনো সুযোগ নেই। ফলে তাদের সঙ্গে মালিকরাও তখন তাল মেলাতে বাধ্য হবেন- যোগ করেন ওই পরিবহণ নেতা। এদিকে তলে তলে বাস মালিকদের অনেকেই যে নতুন সড়ক আইনের বিপক্ষে তা সরেজমিনে অনুসন্ধান এবং রাজধানীর একাধিক বাস মালিকের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সোমবার সকাল থেকে বিকেল অবধি গণপরিবহণ শ্রমিকদের খিলগাঁও বিশ্বরোডের দুই পাশে সায়েদাবাদ-কুড়িল রুটের বিপুল সংখ্যক বাস-মিনিবাস দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে। তারা জানান, মালিকের নির্দেশে তারা এসব গাড়ি রাস্তায় নামাননি। এর মধ্যে বেশকিছু গাড়ির ফিটনেস রয়েছে। শুধুমাত্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলতেই মালিকরা তাদের এ নির্দেশ দিয়েছেন বলেও স্বীকার করেন তারা। যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, কুড়িল বিশ্ব রোড ও সায়েদাবাদ এলাকার বিভিন্ন সড়কেও একইভাবে বিপুলসংখ্যক বাস-মিনিবাস যাত্রীবিহীন অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে। এসব যানবাহনের মালিকরা নতুন সড়ক আইনের বিপক্ষে বলে জানান শ্রমিকরা। অন্যদিকে বাস মালিকদের অনেকেই নতুন সড়ক আইনের পক্ষে থাকলেও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ না দিয়ে তা কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থান্বেষী প্রভাবশালীরা নানা কৌশলে গণপরিবহণকে তাদের নিজেদের মুঠোয় পুরে রেখেছে। তারা এ খাতে নতুন বিনিয়োগকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। খোদ সরকারও পরোক্ষভাবে তাদের সহায়তা দিচ্ছে। এ কারণে গণপরিবহণ খাতটিতে বরাবরই ভগ্নদশা লেগেই রয়েছে। অথচ সে দিকে নজর না দিয়ে সরকার আকস্মিক ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ওপর বিশাল জরিমানার খড়গ ঝুলিয়ে দিয়েছে। রাজধানীর যে কোনো রুটেই নতুন বাস নামাতে হলে ট্রাফিক পুলিশ, রাজনৈতিক ক্যাডার, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামধারী নেতাসহ অনেককেই বিশাল অংকের চাঁদা দিতে হয়। এর ওপর রয়েছে রুট পারমিট পাওয়ার ভোগান্তি। তাই আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও তারা অনেকেই নতুন বাস রোডে নামাতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে নতুন আইন কার্যকরের উদ্যোগ তাদের কাছে 'গোদের উপর বিষফোড়া' বলে মন্তব্য করেন তারা। এদিকে ইসমাইল হোসেন নামের এক বাসচালক জানান, আইনগত নানা জটিলতার কারণে তিনি দীর্ঘদিন বিআরটিএতে ঘুরেও ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে পারেননি। তবে লাইসেন্সধারী অনেক চালকের চেয়ে তিনি দক্ষ। নতুন আইনে বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালালে যে বিশাল অংকের জরিমানা গুনতে হবে তা জানার পর তিনি বাসের স্টিয়ারিং ধরতে আর সাহস পাচ্ছেন না। তাই তিনি এখন অনেকটা দায়ে পড়েই এ নিয়ে কঠোর আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তার মতো আরো অনেকেই এ দলে ভিড়েছে বলেও জানান ইসমাইল। এদিকে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, গণপরিবহণ বলতে যা বোঝায়, রাজধানী ঢাকায় তা আছে নামকাওয়াস্তে। নগরীর ১৬৮টি রুটে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা ৫ হাজার ৪০৭টি। এর মধ্যে মিনিবাস ৩ হাজার ১২৬টি, আর বাস আছে ২ হাজার ২৮১টি। এছাড়া সামান্য কিছু অটোরিকশা-ট্যাক্সিক্যাব ও হিউম্যান হলার নিয়েই গণপরিবহণ ব্যবস্থা ব্যস্ততম এ নগরীতে। ফলে সকাল ও বিকেলের পিক আওয়ারে গণপরিবহণের যাত্রীদের নিত্যদিনই চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে অফিসপাড়াসহ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকার প্রতিটি বাস স্টপেজে যাত্রীদের নিয়মিত মলস্নযুদ্ধ করে গাড়িতে উঠতে হচ্ছে। ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠে হ্যান্ডেলে ঝুলে গন্তব্যে পৌঁছতে গিয়ে অহরহ হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এ সংকটজনক পরিস্থিতি নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে ফিটনেসবিহীন যানবাহন পরিচালনার জরিমানা এক ধাপে কয়েক গুণ বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা এবং ৬ মাসের কারাদন্ডের বিধান করায় পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে। সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা, নতুন সড়ক আইন কঠোরভাবে কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিপুলসংখ্যক লক্কর-ঝক্কর বাস-মিনিবাস রাজধানীর রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যাবে। এ সংকট তীব্র করতে গণপরিবহণের মালিক-শ্রমিকরা বরাবরের মতো তাদের ফিটনেস থাকা সচল গাড়িও রাস্তা থেকে তুলে নেবে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে গিয়ে ঠেকবে। এ সুযোগে গণপরিবহণের মালিক-শ্রমিকরা জনগণকে জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায়সহ নানা নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। এদিকে ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন এবং ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানো অদক্ষ চালকের বিরুদ্ধে নতুন সড়ক আইনে যেভাবে জেল-জরিমানা কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে তা গণপরিবহণে ব্যাপক চালক সংকট দেখা দেবে। এর ওপর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর ঘটনায় চালকের সাজা বাড়ানোর কারণে অনেকের এ পেশা থেকে সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দক্ষ চালক তৈরির বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নিয়েই নতুন সড়ক আইন কার্যকরে কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। পরিবহণ পর্যবেক্ষকরা জানান, প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে গণপরিবহণের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুযায়ী দক্ষ চালক তৈরির কোনো উদ্যোগ কখনো সরকার নেয়নি। বেসরকারি পর্যায়ে চালক তৈরির উদ্যোগও একেবারেই সীমিত। সারাদেশে বিআরটিএ অনুমোদিত ড্রাইভিং প্রশিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৪২ জন। দেশে রেজিস্ট্রেশনকৃত ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৯৮। অনুমোদিত ড্রাইভিং প্রশিক্ষকদের একটা বড় অংশ কোনো কাজ করেন না। ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও বিআরটিএর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই রাতারাতি অষ্টম শ্রেণি শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন বিপুলসংখ্যক দক্ষ চালক তৈরি নেহাত আকাশকুসুম কল্পনা।