মাঠে ভ্রাম্যমাণ আদালত

নতুন আইন কার্যকর হলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি

প্রথম দিনে আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৮৮টি মামলা দায়ের, দুটি গাড়ি জব্দ। রাজধানীর সড়কে গণপরিবহণের সংখ্যা কম, এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী সাধারণ

প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
নতুন সড়ক আইন কার্যকর হলেও রাজধানীর রাজপথের বিশৃঙ্খলা কমেনি। ছবিটি সোমবার তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা এলাকা থেকে তোলা -বাংলার চোখ
সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ কার্যকরের জন্য সোমবার থেকে মাঠে নেমেছে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। আইন সম্পর্কে কেউ কেউ জানলেও অনেক বাস চালকের অভিযোগ, কাগজপত্র না থাকলেও মালিক সড়কে নামতে তাদের নিষেধ করেননি। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে গণপরিবহণ, পথচারী পারাপারের চিত্র তেমন বদলায়নি। বাসগুলোয় ধরা পড়েছে চিরাচরিত সব অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা। গত ১ নভেম্বর নতুন সড়ক পরিবহণ আইন কার্যকর করে সরকার। তবে নতুন আইনে মামলা ও শাস্তি দেওয়ার কার্যক্রম মৌখিকভাবে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার সেই সময়সীমা শেষ হয়েছে। রোববার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, সেদিন থেকেই আইন কার্যকর শুরু হয়েছে। তবে সোমবার মাঠে নামেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারা এদিন ৮৮টি মামলা ও দুটি গাড়ি জব্দ করেন। প্রথম দিন রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় সংসদের দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনীন। দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ বিভিন্ন পরিবহণের সাতটি বাস থামায়। দুপুরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ বলেন, একটি বাসকে জরিমানা করা হয়নি। এর বাইরেও বাসের ভেতরে ভাড়ার তালিকা না রাখা, হাইড্রোলিক হর্ন থাকা, নারীদের জন্য আসন বরাদ্দ না রাখার মতো অপরাধে জরিমানা করা হয়েছে। সোমবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকা বাস থেকে যাত্রীরা নেমে এসেও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। মো. সুমন নামে এক যাত্রী উত্তরা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, 'সিটিং সার্ভিসের কথা বলে ভাড়া আদায় করলেও পথ থেকে যাত্রী তোলে। যদিও ভাড়া কমায় না।' অপর যাত্রী বাসের ভেতরে বসলে আর নড়াচড়া করতে পারেন না বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সিটে কেউ বমি করে গেছে, পরিষ্কার না করেই যাত্রী তোলা হয়। এ সময় গাড়িচালক হইচই শুরু করেন। ওই যাত্রী বলেন, তার কথা শোনার কেউ নেই। এখন ম্যাজিস্ট্রেটকে পেয়েছেন কথা বলবেনই। ম্যাজিস্ট্রেট নিজের আসন ছেড়ে গাড়ির ভেতরে গিয়েও দেখেন। জাতীয় সংসদের উল্টো দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ১৩টি গাড়ি ধরে ৭ হাজার টাকা জরিমানা করেন। ফোরকান নামের এক গাড়ি চালককে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি খুশি মনে জরিমানা দিয়ে বলেন, 'আমার ভাই ম্যাজিস্ট্রেট, মামাতো ভাই সাংবাদিক, মামা ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। চাইলেই জরিমানা মাফ হইত। দিয়া দিলাম।' রাজধানীর কাকলী বাসস্ট্যান্ডের পাশে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত-৪ পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এম এম সামিরুল ইসলাম। বেলা ১টা পর্যন্ত তিনি ৭টি মামলা ও ৯ হাজার টাকা জরিমানা করেন। দুপুরের দিকে একটি বাস থামানো হলে আদালত বাসের ভেতরে গিয়ে দেখেন সংরক্ষিত আসনে কারা বসেছেন। এ ছাড়া বাসটির ফিটনেসও দেখা হয়। বিকাশ পরিবহণের একটি বাস থামানো হলে আদালত দেখেন গাড়ি এবং চালকের কোনো কাগজপত্রেরই মেয়াদ নেই। বাসটি জব্দ করা হলে যাত্রীরা সবাই নেমে যান। বাসের চালক শিবলু রহমান বলেন, তার লাইসেন্স নবায়নের জন্য কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। নতুন আইন জানতেন কিনা এবং গাড়ি নিয়ে চলাচলের বিষয়ে বলেন, 'জানি আইন হইছে, কিন্তু মালিকে তো গাড়ি নিয়ে নামতে মানা করল না।' মো. আলমগীর নামের এক মোটরসাইকেল চালককে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তিনি জানান, তার চার চাকার বাহন চালানোর লাইসেন্স আছে। কিন্তু মোটরসাইকেলের না থাকায় জরিমানা করা হয়েছে। এবার জরিমানার পরিমাণ বেশি হওয়ায় এ নিয়ে মানুষের মনে নানা আলোচনা চলছে। ম্যাজিস্ট্রেট এম এম সামিরুল ইসলাম বলেন, 'জরিমানার সর্বোচ্চ পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। তবে সর্বনিম্নটা বলা হয়নি। জরিমানার পরিমাণ নির্ভর করছে অপরাধের পরিমাণ ও আদালতের ওপর। অনেকের মধ্যে ভীতি সঞ্চারও হয়েছে এটা নিয়ে যে ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেই ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু এটা হচ্ছে সর্বোচ্চ পরিমাণ।' কাকলীতে ট্রাফিক সার্জেন্ট আফসানা ফেরদৌস পথচারীদের সামলানো নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। তিনি বলেন, 'সকাল থেকে কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে পথচারীদের পার করে দেওয়া হয়েছে। একজন-দুজন করে আসতেই থাকে। সবার জন্য যদি গাড়ি থামাতে হয়, তাহলে তো সড়কে গাড়িই চলবে না। আর ফাঁক পেলেই সড়কের মাঝ দিয়ে দৌড় দেবে। পথচারী মেনটেইন অনেক টাফ।' তবে এদিন পথচারীদের কোনো শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান কাকলীতে আদালত পরিচালনা করা ম্যাজিস্ট্রেট। ভ্রাম্যমাণ আদালত থেকে কয়েক গজ দূরে বাসস্ট্যান্ডে চালকের সহকারীরা চালকদের সড়কের ডানদিক দিয়ে চলে যেতে বলছেন, যাতে আদালতের সামনে না পড়েন। এ ছাড়া আদালতের সামনে এসে দেখছিলেন মো. মনিরুজ্জামান। নিজেকে বঙ্গবন্ধু পরিবহণের মালিক পরিচয় দিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, 'আমাদের কথা কেউ বলে না। সব জগাখিচুড়ি অবস্থা। যা যায় সব মালিকের ওপর দিয়া।' তার অভিযোগ, মামলার পর মামলা হয়, কিন্তু দ্রম্নত তার ফয়সালা হয় না। চালকদের লাইসেন্স প্রক্রিয়াতে বিআরটিএর ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, 'একটা লাইসেন্স করতে সাত-আট হাজার টাকা লাগে। ড্রাইভার গরিব, এত টাকা কই পাইব। আর একবার নবায়ন করতে দিলে দিনের পর দিন পার হয়, কাগজ বাইর হয় না, আর রাস্তায় নামলেই মামলা খায়।' তবে তিনি জানান, আইনের প্রতি তারাও শ্রদ্ধাশীল। চালকদের নিয়মিত সচেতন করেন। ৮৮ মামলা ২ গাড়ি জব্দ এদিকে নতুন সড়ক আইন কার্যকর হওয়ার পর সোমবার একদিনেই রাজধানীতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত ৮৮টি মামলা ও দুটি গাড়ি জব্দ করেছে। এসব মামলায় আদালত এক লাখ ২১ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। এ দিন রাজধানীর উত্তরা, বনানী, মতিঝিল, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় মোট ৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। রাজধানীর সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় দুটি পৃথক ভ্রাম্যমাণ আদালতে মোট ৩০টি মামলা এবং ২৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালত-৮ এর অধীনে ১০টি মামলা এবং সাড়ে ১২ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। তিনটি ধারায় এক পরিবহণকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার এবং একটি ধারায় সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে আদালত-৭ এ ২০টি মামলা ও ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সর্বোচ্চ জরিমানা করা হয় ৫০০ টাকা। রাজধানীর সড়কে কমেছে পরিবহণ নতুন সড়ক পরিবহণ আইন কার্যকর হয়েছে গত ১ নভেম্বর। তবে প্রয়োগ শুরু হয়েছে সোমবার থেকে। নতুন আইনটি বাস্তবায়নের প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি জেলায় বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা। নতুন আইন প্রয়োগের প্রথম দিনে রাজধানীতে আটটি মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। প্রথম দিনেই রাজধানীর সড়কে দেখা গেছে গণপরিবহণের সংখ্যা খুবই কম। এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী সাধারণ। সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, যেসব পরিবহণের কাগজপত্র ঠিক নেই ফিটনেসের সমস্যা রয়েছে কিংবা চালকের কাঙ্ক্ষিত মানের লাইসেন্স নেই, তাদের অধিকাংশরাই সড়কে পরিবহণ নামাননি। জরিমানা কিংবা জেলের ভয়ে সড়কে গণপরিবহণের সংখ্যা আগের তুলনায় গতকাল কম দেখা গেছে। সোমবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর ফার্মগেট, খামারবাড়ী, মানিকমিয়া অ্যাভিনিউ, আসাদগেট কলেজগেট, শ্যামলী এলাকা সরেজমিন দেখা যায়, আগের তুলনায় গণপরিবহণের সংখ্যা কম। যে কারণে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী সাধারণও। ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা সিএনজির সংখ্যাও অন্যান্য দিনের তুলনায় কম দেখা গেছে। শ্যামলীর বাসিন্দা রিপন মিয়া কলেজগেট এলাকায় সিএনজিতে ওঠার আগ মুহূর্তে বলেন, 'বংশাল যাব। কিন্তু শ্যামলীতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে যানবাহন পাচ্ছিলাম না। গণপরিবহণ থাকলেও গেট লক করা। সিটের অতিরিক্ত যাত্রীও নিচ্ছে না বাসগুলো। বাধ্য হয়ে হেঁটে কলেজগেট আসলাম। এখানেও বাসে উঠতে না পেরে সিএনজি ধরে রওয়ানা দিচ্ছি।' আসাদগেট এলাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আফসার আলী বলেন, 'এমনি দিনে সড়কে দাঁড়ানো যায় না। গাড়িতে ঠাসা থাকে সড়ক। শব্দে টেকা যায় না। আজ সে রকম কিছু মনে হচ্ছে না। সড়কে গাড়ির সংখ্যা যেন অর্ধেকে নেমেছে।' আসাদগেট এলাকার ট্রাফিক সদস্য রেজাউল বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুক্রবার শনিবার ছাড়া সার্বক্ষণিক চাপ থাকে এই এলাকার সড়কে। কিন্তু এদিন বিশেষ চাপ ছিল না। সব ধরনের পরিবহণ কম লক্ষ্য করা গেছে। নতুন আইনের প্রয়োগে জরিমানা ও মামলা এড়াতেই গাড়ি সংখ্যা সড়কে কমেছে বলে মনে করেন তিনি। এ ব্যাপারে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) এ কে এম মাসুদুর রহমান বলেন, 'মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে। বিশেষ করে পরিবহণ মালিকপক্ষের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন সড়ক পরিবহণ আইন প্রয়োগের প্রথম দিনে সড়কে গণপরিবহণের সংখ্যা কমেছে। কারণ যাদের বা যেসব পরিবহণের কাগজপত্র নেই স্বাভাবিকভাবেই তারা পরিবহণ সড়কে নামাননি। যে কারণে গণপরিবহণের সংখ্যা কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে।'