কলকাতা টেস্ট

গোলাপি উৎসবে ধূসর বাংলাদেশ

ঘণ্টা বাজিয়ে টেস্ট উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রীর ১০৬ রানেই শেষ টাইগার ইনিংস

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ঢং ঢং ঢং। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সের ঐতিহ্যবাহী ঘণ্টা বাজিয়ে শুক্রবার বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত দিবারাত্রির গোলাপি বলের টেস্ট ম্যাচের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ সময় পাশে ছিলেন বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলী ও বেঙ্গল ক্রিকেটের সচিব অভিষেক ডালমিয়া -ফোকাস বাংলা

 


দেশের মাটিতে প্রথম দিবারাত্রির টেস্টকে স্মরণীয় করতে ভারতের কত না আয়োজন। ইডেন গার্ডেন্স ঘিরে চলছে উৎসব। ইতিহাসের নতুন এ অধ্যায়ে নিজেদের মেলে ধরল বিরাট কোহলি ও তার সতীর্থরা। অন্যদিকে, ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খেল বাংলাদেশ। ভারতের দ্যুতির বিপরীতে যেন আঁধারে ডুবে থাকল মুমিনুল হকের দল।
৩ উইকেটে ১৭৪ রান নিয়ে কলকাতা টেস্টের প্রথম দিন শেষ করেছে ভারত। স্বাগতিকরা এগিয়ে আছে ৬৮ রানে। কোহলি ৫৯ ও অজিঙ্কা রাহানে ২৩ রানে ব্যাট করছেন।
এর আগে টস জিতে শুক্রবার ব্যাট করতে নেমে ৩০.৩ ওভারে ১০৬ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। টেস্টে এর চেয়ে কম ওভারে কোনো দলকে প্রথম ইনিংসে গুটিয়ে দিতে পারেনি ভারত। এই সংস্করণে চতুর্থবারের মতো প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট তুলে নেন ভারতের পেসাররা।
এক যুগ পর দেশের মাটিতে পাঁচ উইকেট নিয়ে দিনের সেরা বোলার ইশান্ত শর্মা। উমেশ নিয়েছেন তিন উইকেট, শামি দুটি।
বোলিংয়ে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল আশা জাগানিয়া। পাঁচ বছর পর টেস্ট খেলতে নেমে আল আমিন হোসেন ফিরিয়ে দেন মায়াঙ্ক আগারওয়ালকে। আগের ম্যাচের ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের ক্যাচ গালিতে মুঠোয় নেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
আরেক ওপেনার রোহিত শর্মার উইকেট পেতে পারতেন আবু জায়েদ চৌধুরী। সীমানায় সহজ ক্যাচ ছেড়ে রোহিতকে ১২ রানে জীবন দেন আল আমিন। তবে এর জন্য ইন্দোর টেস্টের মতো দিতে হয়নি চড়া মাশুল। বোলিংয়ে এসেই রোহিতকে এলবিডব্লিউ করে দেন ইবাদত হোসেন।
অনেক বাইরে থেকে ঢোকা বলে কোনো শট খেলেননি রোহিত। আম্পায়ার এলবিডব্লিউ দিলে রিভিউ নেন এই ব্যাটসম্যান। তাতে পাল্টায়নি সিদ্ধান্ত।
ক্রিজে গিয়েই বেশ কয়েকটি বাউন্ডারি তুলে নেন কোহলি। চেতেশ্বর পুজারার সঙ্গে জমে যায় তার জুটি। বাংলাদেশের সংগ্রহ ছাড়িয়ে দলকে লিড এনে দেন তারা। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে ৯৪ রানের জুটি ভাঙেন ইবাদত। আচমকা লাফিয়ে ওঠা বলে স্লিপে সাদমানের হাতে ধরা পড়েন পুজারা।
টানা দুই টেস্টে পঞ্চাশ ছুঁয়ে আউট হলেন পুজারা। ১০৫ বলে খেলা তার ৫৫ রানের ইনিংস গড়া আট চারে। সেই ওভারেই বাউন্ডারিতে টেস্টে ২৩তম ফিফটি স্পর্শ করেন কোহলি। এই ইনিংস খেলার পথে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে কম ৮৬ ইনিংসে পাঁচ হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছানোর কৃতিত্ব দেখান তিনি।
বাকি সময়টা রাহানেকে নিয়ে নিরাপদে কাটিয়ে দেন কোহলি। ব্যাটে-বলে নিজেদের মেলে ধরে প্রথম দিনশেষে চালকের আসনে বসে গেছে ভারত। ৬১ রানে ২ উইকেট নিয়েছেন ইবাদত। আল আমিন ১ উইকেট নিয়েছেন ৪৯ রানে।

এর আগে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস টিকেছে মাত্র ৩০.৩ ওভার। টেস্টে তাদের এর চেয়ে কম ওভার স্থায়ী ইনিংস আছে কেবল পাঁচটি।
বাংলাদেশের ইনিংসে নেই তেমন কোনো জুটি। ত্রিশের ঘর পর্যন্ত যেতে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান। দুই অঙ্ক ছুঁতে পেরেছেন কেবল তিনজন। রানের খাতা খুলতে পারেননি মুমিনুল, মোহাম্মদ মিঠুন, মুশফিকুর রহিম ও আবু জায়েদ।
১০ উইকেট ভাগ করে নিয়েছেন ভারতের তিন পেসার। সবচেয়ে উজ্জ্বল ২২ রানে ৫ উইকেট নেওয়া ইশান্ত শর্মা। ২৯ রানে ৩ উইকেট নেন উমেশ যাদব। আর ঘরের মাঠে মোহাম্মদ শামি ২ উইকেট নেন ৩৬ রানে।
প্রথম তিন ওভারে তেমন কিছু হয়নি। এরপরই শুরু বিপর্যয়ের। ইমরুল কায়েসকে ফিরিয়ে শিকার শুরু করেন ইশান্ত। তিন বলের মধ্যে মুমিনুল ও মিঠুনকে বিদায় করে বাংলাদেশকে এলোমেলো করে দেন উমেশ।
দলকে অনেকবার টেনে তোলা মুশফিকুর রহিম এবার ব্যর্থ। খেলেন ব্যাট-প্যাডে অনেক ফাঁক রেখে, বল তার ব্যাটে লেগে স্টাম্পে আঘাত হানে। আগের টেস্টে ব্যর্থ মাহমুদউল্লাহ পারেননি এবারও। ইশান্তের বলে ফেরেন কিপার ঋদ্ধিমান সাহার দুর্দান্ত এক ক্যাচে।
এক প্রান্ত আগলে রেখে এগোচ্ছিলেন সাদমান ইসলাম। থিতু হয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি এই ওপেনার। উমেশের বলে ফেরেন ঋদ্ধিমানকে ক্যাচ দিয়ে। এটি ভারতীয় কিপারের শততম ডিসমিসাল। সাদমান করেন সর্বোচ্চ ২৯ রান।
ক্রিজে যাওয়ার পর থেকে দারুণ খেলছিলেন লিটন দাস। শামির বাউন্সার হেলমেটে লাগলেও নড়ে যায়নি মনোবল। পরের বলে হাঁকান বাউন্ডারি। পরের ওভারে আসে আরেকটি বাউন্ডারি। অস্বস্তি বোধ করায় সেই ওভারেই মাঠ ছাড়েন লিটন। এই ম্যাচে আর খেলা হচ্ছে না ২৭ বলে ৫ চারে ২৪ রান করা এই তরুণের।
লাঞ্চের পর বেশি দূর এগোয়নি বাংলাদেশের ইনিংস। ইবাদত হোসেনকে বোল্ড করার পর ‘কনকাশন’ বদলি নামা মেহেদী হাসান মিরাজকে থামান ইশান্ত। পরে নাঈমকে বোল্ড করে ইনিংসে দশমবারের মতো পাঁচ উইকেট পান এই পেসার।
আবু জায়েদকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ১০৬ রানে গুটিয়ে দেন শামি। টেস্টে ভারতের বিপক্ষে এর চেয়ে কম রান একটিই আছে বাংলাদেশের। অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের ৯১।

ঘণ্টা বাজিয়ে উদ্বোধন
আরও একটি ক্রিকেট ইতিহাসের সাক্ষী হলো কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে দড়ি টেনে ঘণ্টা বাজালেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ঘণ্টাধ্বনিতেই মাঠে গড়ালো গোলাপি বলে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রথম দিবারাত্রির টেস্ট।
বাংলাদেশ বা ভারত আগে কখনো দিবারাত্রির টেস্ট খেলেনি। তাই গোলাপি বলের সঙ্গে দুই দেশের ক্রিকেটারদের মাঠের মোকাবিলা এটাই প্রথম। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি স্মরণীয় করে রাখতে এলাহি আয়োজন করেন ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের নতুন সভাপতি বাংলার ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলী।
ভারত দলের সাবেক অধিনায়ক গাঙ্গুলী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলেরও সভাপতি। কলকাতা টেস্টের সূচনালগ্নে উপস্থিত থাকতে তিনিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন।
পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। তবে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির কারণে মোদি নিজে কলকাতার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।
বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে চড়ে শুক্রবার সকালে ঢাকা থেকে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছান কলকাতায়। হোটেল তাজ বেঙ্গলে সামান্য বিশ্রাম নিয়েই তিনি চলে যান ইডেনে।   
দুই টেস্টের এই সিরিজের প্রথমটিতে ইতোমধ্যে হেরে গেছে টাইগাররা। কলকাতা টেস্টে টসে জিতে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলে খেলা শুরুর আগে শেখ হাসিনা আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে মাঠে যান সৌরভ গাঙ্গুলী।
এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হাত উঁচু করে দর্শকদের তুমুল উল্লাস আর শুভেচ্ছার জবাব দিতে দেখা যায়।
সবুজ ইডেনে দুই দেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আসে ঘণ্টা পর্ব। অনুষ্ঠানে মঞ্চে রাখা ঘণ্টা বাজিয়ে শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিন-রাতের টেস্টের সূচনা করেন। এর আগে মাঠে দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। 
এই টেস্ট ঘিরে কলকাতা এখন রীতিমতো গোলাপি জ্বরে আক্রান্ত। পুরো ইডেন গার্ডেনকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে নতুন সাজে। মূল প্রবেশদ্বার সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। সেখানেও রয়েছে গোলাপি রঙের প্রাধান্য। কলকাতার বিভিন্ন স্থাপনাতে রাতে হয়েছে গোলাপি আলোকসজ্জার ব্যবস্থা। এমনকি গঙ্গায় নৌকার সাজেও গোলাপি। 
টেস্টের প্রথম সেশনের খেলা দেখার পর হোটেলে ফিরে যান শেখ হাসিনা। মধ্যাহ্নভোজ শেষে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রথম দিনের খেলার পর ইডেন গার্ডেনে বেঙ্গল ক্রিকেট আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, তখন আবার স্টেডিয়ামে যান প্রধানমন্ত্রী।
সেই অনুষ্ঠান শেষে রাতে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী।