বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড শুরু

প্রকাশ | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের আজ তৃতীয় দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের এ দিনে গ্রাম ও শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ বাড়িয়ে দেয়। তবে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যান মুক্তিপাগল বীর বাঙালি। গেরিলা আক্রমণে ঘুম হারাম অবস্থা পাকহানাদার বাহিনীর। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের পরাজিত করে বরগুনাকে মুক্ত করেন বাংলার দামাল ছেলেরা। গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। তাতে রণাঙ্গনে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভারতীয় মিত্রবাহিনী আর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত প্রতিরোধের মুখে পরাজিত হতে থাকে পাক হানাদাররা। অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনী শক্ত মনোবল আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিজয় অর্জনের পথে সব বাধা অতিক্রম করে এগোতে থাকেন দুর্দমনীয় গতিতে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস বরগুনা জেলা ছিল ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এ সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব সেক্টরের অধীনে মুক্তিসেনারা প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধযুদ্ধের একপর্যায়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মুহূর্তে সাব-সেক্টর সদর দপ্তর থেকে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সাত্তার খানের প্রতি বরগুনাকে হানাদারমুক্ত করার আদেশ জারি হয়। ওই আদেশের সঙ্গে সাত্তার খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর বুকাবুনিয়া থেকে বেতাগী থানার বদনিখালী বাজারে গিয়ে অবস্থান নেন। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেনকে ছদ্মবেশে পাঠানো হয় বরগুনা সদরে। তিনি জেলা শহরের পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে খবর পাঠানোর পর মুক্তিযোদ্ধারা বদনিখালী থেকে হেঁটে কালীবাড়ি লঞ্চঘাটে যান। সেখান থেকে রাত ২টায় একটি নৌকায় চড়ে বরগুনা সদরের উদ্দেশে যাত্রা করেন তারা। তীব্র শীত উপেক্ষা করে ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা পোটকাখালী পৌঁছে নিজেদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখে ছয়টি টার্গেট পয়েন্টে অবস্থান নেন। ওই সময় বীর যোদ্ধারা যুদ্ধের সংকেত হিসেবে ফজরের আজানকে ব্যবহার করেন। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চূড়ান্ত করে সিদ্ধান্ত নেন, আজানের সঙ্গে সব পয়েন্ট থেকে একসঙ্গে আক্রমণ শুরু করবেন। সে অনুযায়ী ফজরের আজান শুরু হতেই ছয়টি পয়েন্টে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে শত্রম্নর অবস্থান লক্ষ্য করে একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পরিস্থিতি আর নিজেদের অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে পাকিস্তানি বাহিনীর অনুগত পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়েই স্বাধীন হয় বরগুনা। একাত্তর সালের ৩ ডিসেম্বর কলকাতার গড়ের মাঠে ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ছিল ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। এ ঘোষণার জন্য উন্মুখ হয়েছিল কোটি বাঙালির প্রাণ; কিন্তু কোনো ঘোষণা আসেনি। উল্টো পাকিস্তান বাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, যোধপুনর, আম্বালা এবং আগ্রা বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করে বসে। এ দিন মধ্যরাতে ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর নাজেহাল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান কেন ভারত আক্রমণ করে যুদ্ধের সূচনা ঘটাল, সেটা অনেকের কাছে বড় জিজ্ঞাসা হয়ে রয়েছে। এর আগে ভারত মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে সীমান্ত অতিক্রম করলেও তা ছিল সীমিত সংখ্যায় ও সীমিত আকারে। ভারত যুদ্ধ শুরুর দায় নিজের কাঁধে নিতে চাইছিল না। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়ার নীতি গ্রহণের পরও এ ক্ষেত্রে ভারতের দ্বিধার মূল কারণ ছিল, বিশ্বের সামনে নিজেকে আক্রমণের সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে না দেওয়া। অন্যদিকে একাত্তর সালের এ তারিখে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীর সেনাদের হামলায় নারায়ণগঞ্জের গোদাইল ও চট্টগ্রামের ফুয়েল পাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে পরাজিত হয় দখলদার বাহিনী। রাত ৯টার দিকে একটি অটার বিমান নিয়ে বিমানবাহিনীর দুই চৌকস কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম (স্বাধীনতার পর দুজনই সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) দুজন গানার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি সংরক্ষণাগারে একের পর এক রকেট নিক্ষেপ করেন। সাত ঘণ্টা সফল অভিযান চালিয়ে বিমান নিয়ে ভারতের কৈলা শহর বিমানবন্দরে ফিরে যান তারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম ছোট-বড় সফল অপারেশন বাঙালির বিজয়ের সম্ভাবনাকে আরও সুনিশ্চিত করে তোলে। স্বাধীনতার জন্য দিন গুনতে থাকে স্বাধীনতাকামী বাঙালি। একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর কুমিলস্নায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর চালিয়ে যায় যুদ্ধ। নোয়াখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মুক্ত করে সোনাইমুড়ী। এরপর তারা চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করেন। মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় একাত্তরের এ দিনে। রংপুরের পলাশবাড়ীতে ১২ পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী।