চার্জশিট দিচ্ছে দুদক

ঋণ জালিয়াতির মামলায় ফেঁসে গেলেন সিনহা

এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুজন সাধারণ ব্যক্তির নামে চার কোটি টাকার ভুয়া লোন সৃষ্টি করে নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে চার্জশিটে

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
এস কে সিনহা
যাযাদি রিপোর্ট জালিয়াতি করে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতে বিচারপতি এস কে সিনহার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই মামলায় সাবেক এ প্রধান বিচারপতিসহ মোট ১১ জনকে আসামি করে তৈরি করা চার্জশিটটি যাচ্ছে আদালতে। কমিশন বুধবার এ সংক্রান্ত চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে বলে দুদকের মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। অর্থাৎ এ মামলার বিচার শুরুর উদ্যোগ নিতে অচিরেই চার্জশিটটি আদালতে দাখিল করা হবে। দুদক মহাপরিচালক সাঈদ বলেন, 'এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুজন সাধারণ ব্যক্তির নামে চার কোটি টাকার ভুয়া লোন সৃষ্টি করে নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা হয়েছিল। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন বেনজির আহমেদ। এ মামলায় এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছেন, এটি কমিশন অনুমোদন দিয়েছে। চার্জশিটে আসামির তালিকায় তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে জানান দুদক কর্মকর্তা। তবে মামলার ১১ আসামির মধ্যে ব্যাংকটির গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. জিয়া উদ্দিন আহমেদকে তদন্ত কর্মকর্তা বাদ দিয়েছেন। একজন নতুন যুক্ত হওয়ায় এবং একজন বাদ পড়ায় আসামি ১১ জনই থাকছেন। বিচারপতি সিনহা নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দুই বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমানোর পর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন। অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তের পর চলতি বছরের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ (চার্জশিটে বাদ পড়েছেন), ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়। মামলায় দন্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং মানিল্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২), (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উলেস্নখ করা হয় ঋণের আবেদনে। ওই দম্পতি এস কে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উলেস্নখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে। দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নভেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর 'অস্বাভাবিক দ্রম্নততার' সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইসু্য করা হয় এস কে সিনহার নামে। ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার অ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নভেম্বর। এজাহারে বলা হয়, 'আসামি রনজিৎ চন্দ্র ঋণ দ্রম্নত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রভাব ব্যবহার করেন। রনজিৎ চন্দ্রের ভাতিজা হলেন ঋণ গ্রহীতা নিরঞ্জন এবং অপর ঋণ গ্রহীতা শাহজাহান ও রনজিৎ ছোটবেলার বন্ধু। ঋণ গ্রহীতা দুজনই অত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারা কখনো ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি।' সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন; তিনি এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায়। তবে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসেই একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ওই সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে সিনহার ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে একটি বাড়ি কেনার খবর গণমাধ্যমে আসে। সেটা নিয়েও অনুসন্ধান চালায় দুদক। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।