তবুও উদ্যোগ নেই ইসির

ঢাকা সিটি নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আগাম প্রচারণা

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ঢাকা সিটি নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি। তবুও চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণা -যাযাদি
গত টার্মে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারণের বেশ আগেই সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের রঙিন পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুনে তিলোত্তমা ঢাকাকে শ্রীহীন করে তোলেন। পরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এসব পোস্টার-ব্যানার অপসারণ করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে লোকবল না থাকায় তা বাস্তবায়নে ইসি কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। এ অবস্থায় নির্বাচনী প্রচারণার দিনক্ষণ শুরু হওয়ার পর মনোনীত প্রার্থীরা নতুন পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন লাগানোর ফলে গোটা ঢাকা পরিণত হয় জঞ্জালের শহরে। পরে তা সরাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে বিশাল অংকের অর্থ গচ্ছা দিতে হয়। ওই সময় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হলেও দীর্ঘদিন পরও নূ্যনতম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে এবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনী দামামা বেজে উঠতে না উঠতেই সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুনে গোটা ঢাকার সৌন্দর্য কেড়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের রঙ্গিন পোস্টারে মহানগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডের বাড়িঘর, অফিস আদালতের দেয়াল ঢাকা পড়তে শুরু করেছে। নগরবাসীর আশঙ্কা, এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এখনই কোনো ব্যবস্থা না নিলে দুই সিটির তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা নিয়ে নানামুখী বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফাঁকা জায়গা না পেয়ে প্রার্থীরা একজন অপরজনের পুরানো পোস্টারের ওপর নতুন পোস্টার লাগাবে। কেউ কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোস্টার তুলে ফেলার চেষ্টা করবে। এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টির প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। অথচ এ নিয়ে তাদের মূলত কিছুই করার নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ইসি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক দলগুলোর মর্জির ওপর নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে একজন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, 'বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রার্থীদের প্রচারণায় নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ তাদের নেই। তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত তদারকি করা কমিশনের দায়িত্ব। যেচে গিয়ে কমিশন কোনো ঝামেলায় জড়াবে না। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নেবে।' তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে তাদের কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়নি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর একজন সদস্য এ প্রসঙ্গে বলেন, 'ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাকে মেয়র পদের প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে, কারা দলীয় সমর্থন পেয়ে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করবেন- এর কোনোকিছুই এখনো ঠিক হয়নি। এমনকি নির্বাচন কমিশনও এখনো ভোটের দিনক্ষণ নির্ধারিত করেনি। তাই কে কার পক্ষে পোস্টার লাগাচ্ছে, সেটা তাদের দেখার বিষয় না।' তবে এ ধরনের বেহুদা প্রচারণা চালিয়ে যারা নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট করছেন, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর গতবারের মতো এবারও হয়তো দল সমর্থিত মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীরা পোস্টার-ব্যানার লাগানোর কোনো সুযোগ পাবে না। তাই হয়তো কেউ কেউ আগেভাগেই দুই-একশ' পোস্টার লাগিয়ে মনের খায়েশ মেটাচ্ছেন। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র কিংবা কাউন্সিলর পদে এখনো কাউকে দলীয় মনোনয়ন বা সমর্থন দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন দায়িত্বশীল ওই বিএনপি নেতা। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিপুল সংখ্যক নির্বাচনী ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার লাগিয়েছেন। তবে এতে কেউ নিজেকে সরাসরি প্রার্থী হিসেবে দাবি করেননি। এসব প্রচারণায় এলাকাবাসীর পক্ষে নির্দিষ্ট কোনো নেতাকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে দেখতে চাওয়া হয়েছে। প্রচারণার পোস্টারে দলীয় শীর্ষ নেতা ও স্থানীয় এমপির পাশাপাশি প্রত্যাশিত প্রার্থীরও ছবি রয়েছে। প্রচারণাকারীদের অনেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে নতুন মুখ হলেও কেউ কেউ চলতি টার্মে নির্বাচিত কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজধানীর রমনা থানা এলাকা নিয়ে গঠিত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, এলাকার অধিকাংশ বাসা-বাড়ির সীমানাপ্রাচীর, রাস্তাঘাটসংলগ্ন বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দেয়াল, ফ্লাইওভার-ফুটওভার ব্রিজের পিলার সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মুন্সী কামরুজ্জামান কাজলের রঙ্গিন পোস্টারে ছেয়ে গেছে। ১৯ নং ওয়ার্ডের সর্বস্তরের জনগণের পক্ষে প্রচারিত এই পোস্টারে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ও অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে তাকে পুনরায় কাউন্সিলর হিসেবে দেখতে চাওয়ার কথা উলেস্নখ করা হয়েছে। পোস্টারের ওপরের অংশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ছোট করে দেওয়া আছে। এর নিচেই মুন্সী কামরুজ্জামান কাজলের ঢাউস আকৃতির ছবি। একই ওয়ার্ডে বিভিন্ন দেয়ালে ক্ষমতাসীন দলের আরও একাধিক নেতার একই ধরনের রঙিন পোস্টার লাগানো দেখা গেছে। এসব পোস্টারেও স্থানীয় জনগণের পক্ষে তাদের আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাওয়ার কথা উলেস্নখ করা হয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন বাসাবাড়ির সীমানাপ্রাচীর, রাস্তাঘাট-সংলগ্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দেয়াল এবং মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের বেশকিছু পিলার শহিদুল হাসান শহিদের পোস্টারে ঢেকে গেছে। এলাকাবাসীর পক্ষে প্রচারিত এ পোস্টারে শহিদুল হাসানকে ২৪ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাওয়ার কথা উলেস্নখ করা হয়েছে। রঙিন এই পোস্টারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পাশে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছবি রয়েছে। পোস্টারের নিচের অংশে শহিদুল হাসান শহিদের বড় আকারের ছবি সংযোজিত। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো নির্ধারণ করা না হলেও এ ধরনের রঙিন পোস্টারে নগরীর পথঘাট ঢেকে ফেলার যৌক্তিকতা কোথায়- জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা কেউ এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তাদের সবারই দাবি, এ ধরনের প্রচারণার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। স্থানীয় জনগণ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এ প্রচারণা চালিয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই। এদিকে রঙিন পোস্টার লাগানোর ব্যাপারে তাদের যুক্তি, নির্বাচনী বিধিমালায় রঙিন পোস্টার ছাপার নিয়ম না থাকলেও যেহেতু এখনো নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হয়নি, তাই এ ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা থাকার প্রশ্ন আসে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সম্ভাব্য প্রার্থী রামপুরা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান বাদল বলেন, নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো যেহেতু নির্ধারিত হয়নি তাই এত আগে এ ধরনের পোস্টারিং করার কোনো মানে হয় না। তিনি স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত কুশলাদি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে প্রচারাভিযানের প্রারম্ভিক পর্ব শুরু করেছেন। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের আগে যে ২১ দিন প্রচার-প্রচারণার নিয়ম রয়েছে, ওই সময় পোস্টারিং করবেন বলে জানান তিনি। তবে একই ওয়ার্ডের অপর এক সম্ভাব্য প্রার্থীর ভাষ্য, আগে তিনি নির্ধারিত সময়ে পোস্টারিং করার সিদ্ধান্ত নিলেও এখন তা পাল্টেছেন। কেননা সম্ভাব্য অন্য প্রার্থীরা যেভাবে দ্রম্নত এলাকার বাসাবাড়ির দেয়াল ও পথঘাট নিজ নিজ পোস্টারে ছেয়ে ফেলছেন, তাতে এখন তিনি মাঠে না নামলে তফসিল ঘোষণার পর নতুন করে পোস্টারিংয়ের কোনো জায়গা পাবেন না। তাই ভোট যেদিন হোক, আগেভাগেই পোস্টার ছাপিয়ে অন্য প্রার্থীর সঙ্গে পোস্টারিংয়ের পালস্নায় তিনিও এগিয়ে থাকতে চান। ইসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালায় বলা আছে, 'কোনো প্রার্থী নিজের ছবি ও প্রতীক ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিত্বের নাম ও ছবি ছাপাতে বা ব্যবহার করতে পারবেন না।' কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর অধিকাংশ প্রার্থী তা মানেন না। তবে এবার এ ব্যাপারে যথেষ্ট কড়াকড়ি আরোপের চিন্তাভাবনা রয়েছে। এ কারণে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের দলীয় পরিচয় জানান দিতে এ ধরনের পোস্টারিং করে থাকতে পারে বলে অনুমান করেন তিনি।