রয়টাসের্র প্রতিবেদন

বাংলাদেশে মাদক বিরোধী যুদ্ধের নেপথ্যে

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পথে পুলিশ রিয়াজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। পরে রাত সোয়া ৩টার দিকে ঢাকার উত্তরাঞ্চলে রেললাইনের পাশ্বর্বতীর্ একটি মাঠে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পুলিশ বলছে, অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সে নিহত হয়েছে। তারা ঘটনাস্থল থেকে ২০ কেজি গঁাজাও উদ্ধার করেছে। কিন্তু নিহতের বাবা-মার দাবি, পুলিশ কমর্কতার্রা তাদের থেকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করেছে। পরে তাকে হত্যা করেছে। রিয়াজের মা রিনা বেগম বলেন, ‘আমি জানতাম যে আমার ছেলে পুলিশ কাস্টডিতে আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার ছেলেকে মেরে ফেলা হলো। বিশ্বাস করতে পারিনি এটা। পুলিশ আমাদের থেকে টাকা নিয়েছে। এরপরেও তারা তাকে হত্যা করেছে।’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মাদকবিরোধী যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকবিরোধী অভিযানের ঘোষণা দেন। তখন থেকে এই অভিযানে নিহত দুই শতাধিক মানুষের মধ্যে রিয়াজুল ইসলাম একজন। সমালোচকরা বলছেন, এ অভিযানে শেখ হাসিনার ক্রমবধর্মান কতৃর্ত্ববাদী শাসনের বিষয়টি ফুটে ওঠে। সড়ক দুঘর্টনায় মৃত্যুর প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা সাম্প্রতিক ছাত্র-বিক্ষোভের প্রতি সরকারের প্রতিক্রিয়া, রাবার বুলেট নিক্ষেপ ও বিখ্যাত একজন আলোকচিত্রীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা থেকেও তা বোঝা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেভাবে সহিংস উগ্রবাদকে দমন করেছে, শেখ হাসিনা এখন একইভাবে মাদক সমস্যার সমাধান করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ধরনের অভিযান ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে। ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতেতের্র মাদকবিরোধী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যেটা দেখা গেছে। ফিলিপাইনের মতো বাংলাদেশেও একই ‘স্কিপ্ট’ অনুসরণ করে হত্যাকাÐ ঘটানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা রাতে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এবং সেখান থেকে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অধিকার গত মে মাস থেকে মোট ২১১টি হত্যাকাÐের তথ্য নথিভুক্ত করেছে। এদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ক্ষেত্রে, সন্দেহভাজন অপরাধীকে নিহত হওয়ার আগে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। পুলিশই সন্দেহভাজনদের হত্যা করছে এমন অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন । তিনি বলেন, তাদের আইন প্রয়োগকারী কমর্কতার্রা হত্যা করে না। তারা কাউকে সাজা দিচ্ছে না। এটা অসম্ভব। যদি আসলেই তারা এমনটি করে থাকে, তাহলে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হবে। এটা কোনো আইনবিহীন দেশ না। পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রিয়াজুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ এই ‘শীষর্ সন্ত্রাসী’কে নিয়ে রেললাইনের পাশে অবস্থানকারী অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করতে যায়। মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে গুলি ছুড়তে শুরু করে। আত্মরক্ষাথের্ পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। পরে রিয়াজুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্দুকযুদ্ধে দুই পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন। রিয়াজের ময়নাতদন্তের রিপোটর্ হাসপাতালের একজন কমর্কতার্ রয়টাসের্ক পড়ে শোনান। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি বুলেট তার বাম কানের পাশ দিয়ে মাথায় ঢুকে ডানপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আরেকটি হাসপাতালের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ী, দুই পুলিশকে হালকা আঘাতের চিকিৎসা দেয়া হয়। তাদের একজনের হাত ফুলে যায়। পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ছয় ব্যক্তি রিয়াজুল ইসলামকে মরতে দেখেছেন। কিন্তু বাতার্ সংস্থা রয়টাসের্ক ওইসব সাক্ষীরা বলেন, তাদের কেউই রিয়াজুল ইসলামকে মরতে দেখেননি। তাদের একজন হলেন মোহাম্মদ বাপ্পি। রিয়াজ যে মাঠে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তিনি ওই মাঠের পাশেই থাকেন। ঘটনার দিন মাঠে পড়ে থাকা রিয়াজুল ইসলামের মৃতদেহের কয়েকটি ছবি তোলেন তিনি। এগুলোর একটিতে দেখা যায়, রিয়াজের মাথার নিচে মাটিতে রক্ত পড়ে আছে। বাপ্পি বলেন, সেখানে কোনো বন্দুক ছিল না। সেখানে যদি কোনো বন্দুকযুদ্ধ হতো, তাহলে তারা দুইপক্ষের মধ্যে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেতেন। কিন্তু তা শোনেননি। মাঠের পাশ্বর্বতীর্ একটি পোশাক কারখানার ম্যানেজার রশিদ আলম বলেন, হত্যাকাÐ নিয়ে পুলিশের বক্তব্য কেউই বিশ্বাস করে না। তবে তিনি সমাজে মাদকের ছোবল নিয় বেশ সচেতন। তিনি বলেন, তারা জানতেন সে একজন মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ধরনের মৃত্যু ঠিক আছে। আসলেই এটা ভালো কাজ। ওই অভিযানের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কমর্কতার্ কামাল হোসেন বলেন, মাদক ব্যবহার অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দেয়। তখন গ্রেপ্তারে কাজ হয় না। তিনি বলেন, তারা জামিনে বের হয়ে আসে। পরে একই রকম মাদক সেবন ও বিক্রি করতে থাকে। প্রত্যেক মাদক ব্যবসায়ীকে মেরে ফেলা উচিত। তাহলেই মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে। সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান, বাংলাদেশে নিযুক্ত মাকির্ন রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মে মাসে টেকনাফে র‌্যাবের হাতে একজন সরকারি কমর্কতার্ নিহত হওয়ার পর সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পুলিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি পাঠায়। এতে মানবাধিকারের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা অভিযান অব্যাহত রাখেন। গত জুনে সংসদে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘মাদক দেশ, জাতি ও পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। আমরা অভিযান অব্যাহত রাখব। কে কি বলল তা কোনো বিষয় না।’ মে মাসে অভিযান শুরুর পরপরই বেশিরভাগ হত্যাকাÐ ঘটেছে। তখন প্রায় ১২৯ জনকে হত্যা করা হয়। পরের মাসে হত্যাকাÐের সংখ্যা ৩৮ জনে নেমে আসে। কিন্তু জুলাইতে এ সংখ্যা দঁাড়ায় ৪৪ জনে। দীঘির্দন ধরেই মাদক বাংলাদেশের সরকারের কাছে একটি উদ্বেগের বিষয়। এখানে মুসলিম বিধান অনুযায়ী অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ। তবে দেশে মাদকের ব্যবহার কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে বা কতজন মাদকসেবন করে তা পরিষ্কার না। সংখ্যার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকবিষয়ক সহকারী গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তিনি বলেন, তাদের কাছে মাদকসেবীদের বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে তাদের ধারণা এটা ৭০-৮০ লাখ হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে আটক হওয়া মাদকের চালানের হিসাব অনুযায়ী, দেশে মাদকের ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি ঘটেছে তিন বছর আগে। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে মেথাফেটামাইন বা ইয়াবার চালান ধরা পড়ার প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হত্যাকাÐের শিকার অনেকেই বিরোধী দল বিএনপির কমীর্ ছিলেন। হংকং ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের কমর্কতার্ আশরাফুজ্জামানের কাছে মাদকবিরোধী অভিযানের রাজনীতি পরিষ্কার। তিনি বলেন, ‘২০০ ব্যক্তিকে হত্যা করে বাকি ১৫ কোটি মানুষের মনে এই ভয় সৃষ্টি করা হয়েছে যে, আজ বা কাল তুমিও এদের একজন হতে পার। সরকার জনগণকে এই বাতার্ই দিয়েছে।’ এসব সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মাদকবিরোধী অভিযানের আড়ালে বিরোধী রাজনীতিবিদদের টাগের্ট করা হয়েছে এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, মাদকসেবীদের মধ্যে কোনো পাথর্ক্য করা হবে না। তার পরিচয় হলো অপরাধী। এমনকি সে যদি সরকারি দলের সঙ্গেও যুক্ত থাকে, তারপরও তাকে ছাড় দেয়া হবে না।