গোয়েন্দা প্রতিবেদন

চালের বাজার কারসাজিতে ৩ মিল মালিকের সিন্ডিকেট

প্রকাশ | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

তানভীর হাসান
বেশ কদিন ধরেই ধানের দাম কমলেও চালের বাজার আগের মতোই চড়া রয়েছে। বিশেষ করে চিকন চালের দর কেজিপ্রতি ৬-১০ টাকা বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। ধানের জোগান স্বাভাবিক থাকলেও চালের বাজার চড়া হওয়ার নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে বাজার সংশ্লিষ্ট ও গোয়েন্দারা বিশেষ সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চক্রটি হচ্ছে তিন মিল মালিকের সিন্ডিকেট। তারা হলেন- দেশের চালের সর্ববৃহৎ মিল মালিক কুষ্টিয়ার আব্দুর রশিদ, নওগাঁর আলহাজ বেলাল হোসেন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের এরফান আলী। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ধানের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরে ধানের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তারাই চালের দাম বাড়িয়েছে। কেবলমাত্র ব্যাপক চাহিদা থাকা মিনিকেট ( চিকন চাল) চালের ক্ষেত্রে তারা এ কৌশল অবলম্বন করেছে। এ সুযোগে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করেছেন। কিন্তু চালের দাম বাড়িয়ে কত টাকা সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু উলেস্নখ নেই। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের একটি কপি যায়যায়দিনের হাতে এসেছে। প্রতিবেদনটি গত সপ্তাহে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুর রশীদ ও তার পরিবারের সদস্যরা একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে পুরো পরিবার আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। রশীদের ভাই সিদ্দিকুর রহমান কুষ্টিয়া মিরপুরের আইলতাড়া ইউনিয়নের আওয়ামীপন্থি চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি বিএনপিপন্থি চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অপরদিকে, সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য নওগাঁর আলহাজ বেলাল হোসেন 'বেলাকোন' গ্রম্নপের চেয়ারম্যান। তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও সরকারদলীয় নেতাদের সাথে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর এরফান আলী হলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য এ তিন মিল মালিকের সিন্ডিকেটকে দায়ী করে বলা হয়েছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে তারা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করছে। গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুর রশিদ যায়যায়দিনকে বলেন, চালের দাম বৃদ্ধিতে তার কোনো ভূমিকা নেই। তার মতে, তিন-চারজন বা পাঁচ-দশজন মিল মালিকের পক্ষে সারাদেশে চালের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। তার দাবি, তিনি কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নন। বিষয়টি নিয়ে তিনি খাদ্যমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তারপরও তদন্তে তিনি দোষী প্রমাণিত হলে তাকে যে শাস্তি দেওয়া হবে তা তিনি মেনে নেবেন বলে জানান। এ বিষয়ে বেলাল হোসেন বলেন, চালের দাম খুব একটা বাড়েনি। আগে যেখানে কেজিপ্রতি ছিল ৪০ টাকা এখন হয়েছে ৪২ টাকা। তার প্রশ্ন, এটা কী বাড়ানো হলো? সব মিল এখন লোকসানে চলছে দাবি করে তিনি বলেন, দাম যা বাড়ার খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে। এর সঙ্গে তাদের মতো মিল মালিকদের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে এরফান আলী দাবি করেন, তিনি কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নন। চিকন চালের ( মিনিকেট) চাহিদা বেশি থাকায় একসময় দাম বেড়েছিল, তা আবার কমে গেছে। তিনি বলেন, তারা আড়ৎদাড়ের কাছে চাল বিক্রি করেন। তারপর আরও তিনটি হাত বদল হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ওই তিন হাতে যদি চালের দাম বাড়ায় তাহলে তাদের কী করার আছে? গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। এ দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার সুযোগে অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাই চালের দাম মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার জন্য সরকার গৃহীত বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোকে গতিশীল করতে হবে। দাম নিয়ন্ত্রণে মিল মালিক, আড়ৎদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই যেন সিন্ডিকেট গঠন না করতে পারেন, সেদিকে নিরীক্ষণ ও নজরদারি বাড়াতে হবে। এছাড়া চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গঠিত উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম ও মনিটরিং গতিশীল করার সুপারিশ করা হয়েছে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এদিকে, বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নানজীন আহমেদ সম্প্রতি চালের বাজার নিয়ে এক গভেষণায় দাবি করেছেন, মজুত আইন অনুযায়ী ধারণ ক্ষমতার পাঁচ গুণ ধান ৩০ দিন এবং দ্বিগুণ চাল ১৫ দিন পর্যন্ত মজুত করা যায়। এটি মানছে কি না সেটি মনিটরিং করতে হবে। দেশে মোট চালের ২০ শতাংশের মতো মজুত করতে পারে বড় ৫০টি মিল। এখানে মনিটরিং জোরদার করতে হবে যাতে কোনো মিলার বেশি সময় ধান বা চাল আটকে না রাখতে পারেন। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে শনিবার মিনিকেট চালের বাজার দর ছিল ৫০-৬০ টাকা। এক মাস আগে যা ছিল ৪৫-৫৬ টাকা। এ হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৪ টাকা। যদিও বাজারের বাস্তবতা ভিন্ন।