সু চি গণহত্যার প্রতীক আমরা তাকে ঘৃণা করি

রোহিঙ্গাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া

প্রকাশ | ১১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
নেদারল্যান্ডসের হেগ-এ জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতে মঙ্গলবার অন্যদের সঙ্গে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি -ইন্টারনেট
যাযাদি ডেস্ক নেদারল্যান্ডসের হেগ-এ জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হয়েছে মিয়ানমার। নিজ দেশের হয়ে আইনি লড়াই করছেন রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি। ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলবে এই মামলার শুনানি। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ওই শুনানির দিকে তাকিয়ে আছে। আদালতে সু চির উপস্থিতি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তারা। সু চিকে গণহত্যার প্রতীক আখ্যা দিয়ে এক সময়কার গণতন্ত্রপন্থী ওই নেত্রীর প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছে রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ। জাতিসংঘ জানিয়েছে, 'গণহত্যার উদ্দেশ্য' নিয়ে এই অভিযান চালানো হয়েছিল। মিয়ানমার তীব্রভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের হামলার জবাবেই তারা অভিযান চালিয়েছিল। মোহাম্মদ জুবায়ের নামে ১৯ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা আল-জাজিরাকে বলেন, 'আমরা ধর্ষণ, নিপীড়ন ও হত্যাকান্ড দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে অনেকে খুন হয়েছে। আমাদের সামনে পালানো ছাড়া কোনও পথ ছিল না। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে যেন মিয়ানমার তাদের ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি পায়। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার জন্য তাদের অবশ্যই দায়ী করতে হবে।' তিনি বলেন, 'ক্ষমতায় আসার আগে সু চিই বলেছিলেন সেনাবাহিনী ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। আর এখন তিনি নিজেই সেনাবাহিনীর পক্ষে লড়াই করছেন। কি লজ্জার!' জুবায়ের আরও বলেন, 'আমরা শুনানির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমাদের এখানে ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল হওয়ায় আমরা নিশ্চিত নই যে তা শুনতে পারব কিনা।' নুর আলম নামে ৬৫ বছর বয়সি এক রোহিঙ্গা আল-জাজিরাকে জানান, ২০১৭ সালের ওই অভিযানে ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি। বলেন, 'একসময় অং সান সু চি শান্তির প্রতীক ছিলেন। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল যে ক্ষমতায় আসলে অনেক পরিবর্তন আসবে। আমরা তার জন্য প্রার্থনা করেছি। আর এখন তিনি গণহত্যার প্রতীক। আমাদের রক্ষা না করে তিনি খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তিনি তাদের হয়ে লড়াই করবেন। আমরা তাকে ঘৃণা করি। তার লজ্জা হওয়া উচিত।' নুর আলম আরও বলেন, 'আমি অনেকদিন ধরেই এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। তাদের শাস্তি দেখতে পারলে আমার জীবনে আর কোনও অপ্রাপ্তি থাকবে না।' ৩৫ বছর বয়সী রশিদ আহমেদ জানান, 'তার পরিবারের ১২ সদস্যকে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, শুধুমাত্র ন্যায়বিচারই আমাদের ক্ষত শুকাতে পারে। আমি জানি, যাদের হারিয়েছি তাদের কখনোই ফিরে পাব না। কিন্তু খুনির সাজা পেলে তারা শান্তিতে থাকবে।' ৩ বছর বয়সী সন্তানকে কোলে নিয়ে মমতাজ বেগম নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, তার স্বামীকে সেনা সদস্যরা হত্যা করেছেন। ৩১ বছর বয়সী এই রোহিঙ্গা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,? 'তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ছয় বছর বয়সী মেয়ের মাথায় ছুরিকাঘাত করে। আমি শুনলাম অং সান সু চি ও সেনাবাহিনীর বিচার হবে। আমাদের দাবি, সু চি ও সেনাবাহিনীর বিচার হোক। তারা কেন নিরপরাধ মানুষগুলোকে মারল, আমাদের শিশুদের হত্যা করল। তারা কেন আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ ও নিপীড়ন করল? আমরা বিচার চাই।' ২৯ বছর বয়সী জামালিদা বেগম বলেন, তাকে ২০১৬ সালে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তার স্বামীকেও হত্যা করা হয়। 'সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে এসে আমার স্বামীকে হত্যা করে ও বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তিনজন সেনা সদস্য আমাকে টেনে নিয়ে যায় এবং বন্দুক ঠেকিয়ে ধর্ষণ করে। একটা সময় আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।' বলেন তিনি। জামালিদা বলেন, 'আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাই। পরে আমার পোস্টার টাঙিয়ে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাকে খুঁজতে থাকে সেনাবাহিনী। আমি শুধু বিচার চাই। আমি চাই যারা আমাদের ধর্ষণ করেছে, হত্যা করেছে, বাড়িতে আগুন দিয়েছে, শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করেছে তাদের শাস্তি হোক।' মঙ্গলবার সকাল ও দুপুরে কক্সবাজারের বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে জড়ো হয়ে রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষরা আলাদাভাবে ছোট পরিসরে সমাবেশ করেছেন। এসময় তারা 'গাম্বিয়া, গাম্বিয়া' বলে স্স্নোগান দেন। জানা গেছে, মঙ্গলবার ফজরের নামাজ শেষে রোহিঙ্গারা উখিয়া বালুখালী ক্যাম্পের পাহাড়ের ধারে জড়ো হতে শুরু করে। এ সময় তাদের হাতে ইংরেজিতে ওআইসি'র কাছে বিচার দাবি, 'আমরা রোহিঙ্গা' এবং 'আমরা গাম্বিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়েছি' লেখা ফেস্টুন ও পস্ন্যাকার্ড ছিল। এছাড়াও টেকনাফের লেদা, জাদিমুরো, উখিয়ার বালুখালী, জামতলী, লম্বাশিয়া, মধুরছড়া ও সীমান্তে শূন্য রেখায় রোহিঙ্গারা দোয়া মাহাফিল করে মিয়ানমারের শাস্তির দাবি জানান। কিছু ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারীরাও আলাদা করে দোয়া মাহফিল করেন। এতে রোহিঙ্গা শিশুরা অংশ নেয়। এসব ক্যাম্পের দোয়া মাহফিল ও সমাবেশগুলোও ভিডিও ধারণ করে রোহিঙ্গাদের কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে প্রচার করা হয়। উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আমান উলস্নাহ বলেন, 'সকালে শিবিরের কিছু লোকজন পাহাড়ের কাছাকাছি জড়ো হয়ে দোয়া মাহফিল করেছে। যাতে নেদারল্যান্ডের হেগে শুরু হওয়ায় মামলায় মিয়ানমারের কঠোর শাস্তি হয়। রাখাইনে সেনাবাহিনীরা রোহিঙ্গাদের ওপর সংগঠিত গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ সকল অপরাধের শাস্তি পায়। এর সুষ্ঠু বিচার চাই আমরা।'