গোয়েন্দা প্রতিবেদন

নজরদারির দুর্বলতায় বাজার নিয়ন্ত্রণহীন

সিন্ডিকেট ভেঙে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে গোয়েন্দারা সতর্ক করেছেন

প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল ও তানভীর হাসান
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির কারণে বাজার সিন্ডিকেট ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তারা পরিকল্পিতভাবে তাদের খেয়াল-খুশিমতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। এতে দেশজুড়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে। যা সরকারের জনপ্রিয়তায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দ্রম্নত এ সিন্ডিকেট ভেঙে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে-এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের কাছে বিশেষ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজের দামে হঠাৎ অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চিকন চালের দাম কেজিপ্রতি সাত-আট টাকা, মোটা চালের দাম চার-পাঁচ টাকা, খোলা ময়দা কেজিতে সাত-আট টাকা, আটা এক-দুই টাকা বেড়ে যায়। তাছাড়া সোয়াবিন তেলের দামও বেড়ে যায়। পূর্ব প্রস্তুতি নানা থাকায় পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এতে সাধারণের মধ্যে সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যপণ্যের দাম সুপরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি করে বাজারকে অস্থির করে তুলেছে, যা বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। অবিলম্বে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা সাধারণ জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গত ২১ নভেম্বর বৈঠক করে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাটি। চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও হঠাৎ করে এর মূল্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা মিল মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করেন ওই সভায়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এক্ষেত্রে ভারত থেকে সিংহভাগ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এ বছর ভারতে আকস্মিক বন্যার কারণে পেঁয়াজ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এ কারণে দেশটি থেকে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আমদানি করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সংশিষ্ট সংস্থার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। এ দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় সিন্ডিকেট গঠন করে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। প্রসঙ্গত, নভেম্বরে চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ মনিটরিং টিম এবং কন্ট্রোল রুম খোলে সরকার। পেঁয়াজের পর চালের দামে যাতে কারসাজির মাধ্যমে কেউ মূল্যবৃদ্ধি করতে না পারে তার জন্য আগেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে, চালের বাজারদরে ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা রোধে ঢাকা মহানগরের বড় বড় পাইকারি বাজার সরেজমিন তদারকির জন্য তিনটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি-১-এর নেতৃত্বে রয়েছেন সিনিয়র সহকারী সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। কমিটি-২-এর নেতৃত্বে খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নূরুল আলমের নেতৃত্বে কমিটি-৩ গঠন করা হয়। প্রত্যেক কমিটিতে তিনজন করে সদস্য রয়েছেন। এই তিনটি কমিটিকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাজধানীর বাজার মনিটরিং চালিয়ে যাওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে, নিত্যপণ্যের বাজারের এখনো চলছে অস্থিরতা। পেঁয়াজের দামে কোনো সুখবর নেই। চাল-ডাল-তেলসহ শীতের শাক-সবজির দামও আকাশছোঁয়া। গত মাসে হঠাৎ করে কেজিপ্রতি চার থেকে সাত টাকা বেড়ে যায় চালের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে চালকল মালিক ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করে জেলা প্রশাসন। এতে কিছুটা স্থিতিশীল হয় চালের বাজার। অন্যদিকে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসার পরও ঝাঁজ কমছে না। এখনো আকাশচুম্বী দরে বিক্রি হচ্ছে দেশি পেঁয়াজ। মঙ্গলবার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৬০ টাকা। তবে পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজ ২৪০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খুচরা পর্যায়ে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৩০-২২০ টাকা এবং পাইকারিতে ১১০-১৯০ টাকা। মুড়িকাটা নতুন পেঁয়াজের দাম ১৫০-১৮০ টাকা। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, দ্রব্যের মূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার জন্য সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো গতিশীল করতে হবে। মিল মালিক,আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই যেন সিন্ডিকেট করতে না পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। দায়ী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে গঠিত উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম ও মনিটরিং আরও গতিশীল করারও পরামর্শ দেয় গোয়েন্দা সংস্থাটি। এ ব্যাপারে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারের মনিটরিং না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অক্টোবর মাসে সরকার সরাসরি আমদানির মাধ্যমে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে বাজার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ত না। ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর না করে সরকারের সরাসরি পণ্য সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই। ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক বিভাগ অথবা স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা উচিত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি মন্ত্রণালয় কাজ করছে; অথচ তাদের সমন্বয় নেই। তাই পৃথক বিভাগ বা মন্ত্রণালয় দরকার।