এনবিআরকে দুদক

রাজস্ব ফাঁকি রোধে সব বন্দরে স্ক্যানার

বিস্ফোরক, অস্ত্র বা নিরাপত্তা হুমকি হতে পারে এ ধরণের পণ্যের প্রবেশ ঠেকানোও অন্যতম উদ্দেশ্য

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
স্ক্যানার মেশিন -ফাইল ছবি
আমদানি-রপ্তানিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং রাজস্ব ফাঁকি কঠোরভাবে প্রতিরোধে দেশের সব নৌ, বিমান ও স্থলবন্দরে স্ক্যানার বসানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত স্বাক্ষরিত আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারে স্ক্যানিং করতে প্রবেশ গেটে স্ক্যানার মেশিন বসাতে রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে দুদক। সেইসঙ্গে চিঠির অনুলিপি পাঠিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান এবং নৌ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। দুদক মনে করে, সব বন্দরে স্ক্যানার বসানো হলে রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধের পাশাপাশি কনটেইনারে কোনো বিস্ফোরক, অস্ত্র বা নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টিকারী কোনো পণ্য আছে কি না, তা যাচাই করা সম্ভব হবে। তেমনি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো পণ্য দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। পাশাপাশি চোরাচালানও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। চিঠিতে দুদক জানায়, যতক্ষণ না রাজস্ব বোর্ড চট্টগ্রাম বন্দর এবং অন্যান্য সমুদ্র ও নদী বন্দরগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করতে না পারে ততক্ষণে সমস্ত আমদানি ও রপ্তানি সামগ্রীর শতভাগ কায়িক ( ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন) যাচাইয়ের যেন ব্যবস্থা করা হয়। স্ক্যানার হলো- এমন একটি যন্ত্র, যার ভেতর দিয়ে কোনো কনটেইনার বা পণ্যের ব্যাগ প্রবেশ করালে তার ভেতরে কোন ধরনের পণ্য রয়েছে, তা কম্পিউটারে দেখা যায়। বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্য স্ক্যানিং করে খালাস করা হলে কোনো আমদানিকারক এক পণ্য এনে অন্য পণ্য ঘোষণা দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করতে পারবেন না। আবার বেশি দামের পণ্য এনে কম দামি পণ্য হিসেবে বা উচ্চ শুল্ককরের পণ্য আমদানি করে বিনা শুল্ক বা কম শুল্কের পণ্য হিসেবে ছাড় করাতে পারবেন না। জানা গেছে, গত ২৫ ও ২৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র কোস্টগার্ডের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করে। তারা বন্দরের নিরাপত্তা বিশ্বমানে উন্নীত করতে সাইবার নিরাপত্তা, পণ্যবাহী কনটেইনার স্ক্যানিং এবং বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাস বন্ধসহ ৫ দফা সুপারিশ করেন। যদিও চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী রপ্তানি পণ্য স্ক্যানিং করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এর আগে ৮ মে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে আ হ ম মুস্তা কামাল বলেন, আগামী বছর থেকে মালামাল যা দেশে আসবে-যাবে, তার শতভাগ স্ক্যান করা হবে। এ বিষয়ে আইন করা হবে। ওই সভায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জন্য দুটি কনটেইনার স্ক্যানার কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে মোট ব্যয় হবে ৯০ কোটি ৩১ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, ওই দুটি স্ক্যানারের মধ্যে একটি স্ক্যানার ১ নম্বর গেটে আমদানিকৃত কনটেইনার স্ক্যানিংয়ের জন্য বসানো হচ্ছে। অপর স্ক্যানারটি রপ্তানি গেটে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুদকের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরসহ অন্যান্য সমূদ্রবন্দর ও নদীবন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় মালামাল খালাস এবং শুল্ক ফাঁকির বিষয়ে কমিশনে একটি অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগটি দদুক অনুসন্ধান করে। আর তাতে দেখা গেছে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য খালাস করে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। যদিও বিচ্ছন্নভাবে দু-একটি ঘটনা ধরা পড়ে। তবে অধিকাংশ ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনা শুল্ক কর্তৃপক্ষের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এবং সরকারও সঠিক রাজস্ব আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুদক আরও বলেছে, স্ক্যানিং এবং শারীরিক যাচাইয়ের স্থানটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা সিস্টেমের আওতায় আসা উচিত। তবে এনবিআর অবশ্য বলেছে রাজস্ব বোর্ডও সমস্ত বন্দরে রপ্তানি এবং আমদানি স্ক্যানিং সিস্টেমের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কনটেইনারে স্ক্যান করার জন্য বিদ্যমান স্ক্যানারের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতোমধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকায় আরও ১৪টি কনটেইনার স্ক্যানার সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে বর্তমানে ১১টি স্ক্যানার রয়েছে, যার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে সাতটি, বেনাপোল স্থলবন্দরে দুটি এবং মোংলাবন্দর ও কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোতে একটি করে স্ক্যানার রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ লক্ষ্যে ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ স্ক্যানার কিনবে, যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বন্দরে বসানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পণ্যভেদে স্ক্যানার বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন পণ্যবাহী কনটেইনার পরীক্ষার জন্য ফাস্ট স্ক্যানার, গাড়ি স্ক্যানিংয়ের জন্য ভেহিকেল স্ক্যানার, যাত্রী স্ক্যানিংয়ের জন্য হিউম্যান বডি স্ক্যানার, যাত্রীর লাগেজ স্ক্যানিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাগেজ স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী একেক বন্দরে একেক রকম স্ক্যানার বসাতে হবে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, যেসব পণ্য রপ্তানির বিপরীতে সরকার থেকে নগদ সহায়তা পাওয়া যায়, অনেক রপ্তানিকারক ওই সব পণ্য রপ্তানি না করে কনটেইনারের ভেতর অন্য পণ্য পাঠান। কিংবা কেউ কেউ উচ্চ শুল্কমূল্যের পণ্য আমদানি করে কম শুল্কমূল্যের পণ্যের ঘোষণা দেন। স্ক্যানার বসালে এসব অপরাধ কমবে। যার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়ে যাবে। এছাড়া জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য বা বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য আমদানি করতে পারবে না। পাশাপাশি যাত্রী কিংবা যাত্রীর লাগেজ শতভাগ স্ক্যানিং হলে চোরাচালানও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে আসবে।