ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান

নানামুখী চাপে পিছু হটছে সরকার!

প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ফিটনেসবিহীন একটি বাস Ñফাইল ছবি
শিক্ষাথীের্দর আন্দোলনের মুখে ঢাকাসহ সারাদেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ টানা ১০ দিন সঁাড়াশি অভিযান চালালেও ঈদকে সামনে রেখে তা শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও তা পুরোপুরি গুটিয়েও নেয়া হয়েছে। তবে ঈদের পর এ অভিযান ফের জোরদার করার সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যবতীর্ এ সময়টুকু পরিবহন নেতারা জোড়াতালি দিয়ে সাবির্ক পরিস্থিতি সামাল দেবেন। প্রশাসনকে পিছু হটিয়ে কৌশলে সে দায়ভার পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের হাতে তুলে দিচ্ছে সরকার। প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, ট্রাফিক অভিযান চলমান থাকলে আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গণপরিবহন সংকটে ঘরমুখো মানুষের চরম ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ট্রাক সংকটের কারণে কোরবানির পশু পরিবহনে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হবে। যার প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই পশুর দাম বাড়বে। আমদানি-রপ্তানিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের চাপ রয়েছে। তাই সবদিক বিবেচনায় সরকারকে দ্রæত পিছু হটতে হয়েছে বলে জানায় প্রশাসনিক সূত্রগুলো। এদিকে আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এরই মধ্যে ব্যবসা-বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের নানা সংকটে পড়তে হয়েছে। শিক্ষাথীের্দর আন্দোলন চলাকালে প্রায় এক সপ্তাহ অনেকেই তাদের উৎপাদিত পোশাক ঠিকমতো শিপমেন্ট করতে পারেনি। এ সময় বেশ কিছু বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন। যা এ খাতের উদ্যোক্তাদের চাপে ফেলেছে। এর ওপর ট্রাফিক অভিযান জোরদার হওয়ায় পণ্যবাহী ট্রাক লরি এত দিন ঠিকমতো চলেনি। ফলে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার আরও চড়া হয়ে উঠছে। তাই যে কোনো কৌশলে পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক করতে ব্যবসায়ী নেতারা সরকারকে চাপ দিয়েছেন। অন্যদিকে চলমান ট্রাফিক অভিযানের মুখে পরিবহন ব্যবসায় ধস নামায় এ খাতের মালিক-শ্রমিকরাও নানাভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। কোনো ধরনের সুযোগ না দিয়ে আকস্মিক তাদের আইনি জালে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলে তারাও ভিন্ন চিন্তা করবেন বলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সাফ জানিয়ে দেন। এ পরিস্থিতি সরকার কৌশলে সে বল পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের কোটে ঠেলে দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কদিন আগে থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বিভিন্ন বাসটামির্নালে গাড়ির ফিটনেস, নিবন্ধন, রুট পারমিট ও চালকের লাইসেন্স যাচাই করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। এদিকে দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চালকদের ভাষ্য, ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চলমান অভিযান সহসা শিথিল করা না হলে ঈদকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের দুভোর্গ চরমে গিয়ে ঠেকত। সড়কপথের পরিবহন সংকটের কারণে অনেকেই ঈদযাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হতো। কোরবানির পশুর পাশাপাশি সব ধরনের নিত্যপণ্যের দর আরও হু হু করে বাড়ত। ঢাকা-খুলনা রুটের একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবহন কোম্পানির ব্যবস্থাপক জানান, ট্রাফিক ও পরিবহন নেতাদের অভিযান চলমান থাকলে এবারের ঈদযাত্রায় তাদের ৩৪টি গাড়ির মধ্যে মাত্র ১২টি চলত। বাকিগুলোর ফিটনেস না থাকায় এসব গাড়ির ঈদের আগাম টিকিট বিক্রি করা হয়নি। তবে ঈদযাত্রা শুরুর পর এ ব্যাপারে শিথিলতা দেখানোর পর ওই সব গাড়িই রাস্তায় নামানো হচ্ছে। তিনি জানান, এত দিন পুলিশকে ম্যানেজ করে গাড়ি চালানোর কারণে তাদের কোম্পানির অধিকাংশ বাসের ফিটনেসসহ প্রয়োজনীয় বেশ কিছু কাগজপত্র আপটুডেট করা হয়নি। তবে সঁাড়াশি অভিযানের মুখে দ্রæত এসব কাগজপত্র তৈরি ও নবায়ন করার জন্য বিআরটিএতে দৌড়ঝঁাপ করা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ সব কাগজ হাতে পাওয়া যাবে তা অনিশ্চিত। তাই তারা কোনো ঝুঁকি না গিয়ে এসব গাড়ির টিকিট বিক্রি করেনি। একই রুটের অপর এক বাসমালিক এ বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এত দিন কারও কাগজ লাগেনি, তাই কেউ সেদিকে নজর দেয়নি। এখন চাপে পড়ে সবাই কাগজপত্র তৈরি-নবায়নে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অথচ বিআরটিএর লজিস্টিক সাপোটর্ ও ম্যানপাওয়ার কম হওয়ায় তারা দ্রæত তা করতে পারছে না। ফলে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ওই গাড়ি মালিকের দাবি, চালকের মাত্র এক তৃতীয়াংশের ‘হেভি ড্রাইভিং লাইসেন্স’ (বাস-ট্রাক-লরিসহ ভারী যানবাহন চালানোর উপযোগী) রয়েছে। বাকিদের একটি বড় অংশ এত দিন ‘লাইট ড্রাইভিং লাইসেন্স’ (প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ ছোটখাটো যান্ত্রিক যান চালানোর উপযোগী) দিয়েই বাস-ট্রাক চালাচ্ছিল। এ ছাড়া অপেশাদার লাইসেন্সধারীদের হাতেও এত দিন দূরপাল্লার বাসের চাবি তুলে দেয়া হয়েছে। তাই আকস্মিক কড়াকড়ির কারণে উপযুক্ত লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক না পেয়ে অনেকে দূরপাল্লার রাস্তায় গাড়ি নামাতে পারেননি। পরিবহন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রতি বছর ঈদের আগে নগরসাভিের্সর বিপুলসংখ্যক বাস-মিনিবাস দূরপাল্লার যাত্রী বহন করে। বিশেষ করে গামের্ন্টস শ্রমিকদের একটি বড় অংশ এসব যানবাহনের ওপরই নিভর্রশীল। তাই ঈদের আগে ট্রাফিক অভিযান শিথিল করা না হলে নিম্নবিত্তের একটি বড় অংশের গ্রামে ফেরা কঠিন হবে। এদিকে জোরালো ট্রাফিক অভিযানের কারণে দূরপাল্লার যানবাহনের সংকট এরইমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঢাকার কমর্জীবী মানুষ প্রতি বছর ঈদের বেশ ক’দিন আগে পরিবার-পরিজন নিবিের্ঘœ বাড়ি পাঠাতে পারলেও এবার তা কঠিন হয়ে দঁাড়িয়েছে। অনেক রুটেই ১০ আগস্টের আগে থেকেই টিকিট সংকট চলছে। প্রতি বছর এ সময়ের টিকিট সহজলভ্য থাকলেও এবার তা চড়ামূল্যে কালোবাজারে বিক্রির নজির রয়েছে। অন্যদিকে চলমান ট্রাফিক অভিযানের কারণে কোরবানির পশু ও বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্রাক সংকটের চিত্রও বেশ প্রকট। যার ফলে এরই মধ্যে ট্রাক ভাড়া বেশকিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী, রংপুর ও বগুড়াসহ দেশের যেসব অঞ্চল থেকে কোরবানির পশু সংগ্রহ করা হয়, ওই সব এলাকায় ট্রাকভাড়া এরই মধ্যে এক থেকে দেড় গুণ বেড়েছে বলে গরুর ব্যাপারিরা জানিয়েছেন। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে সামনের তিন-চার দিন পর ট্রাক ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। ঢাকার গরুর ব্যাপারি সোলায়মান জানান, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরুর আগে রাজশাহী থেকে গরু আনতে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দিতে হয়েছে। অথচ এখন তা বেড়ে ১৬ থেকে ১৮ হাজারে এসে দঁাড়িয়েছে। এ কারণে তাদের চড়া দরে গরু বিক্রি করতে হচ্ছে। তার ভাষ্য, ট্রাকভাড়া ১০ হাজার টাকা বাড়লে ব্যাপারিদের অনেকে প্রতিটি গরুর সঙ্গে এ দর যোগ করে দাম হঁাকেন। যে হুজুগ সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে। অথচ একটি ট্রাকে মাঝারি সাইজের অন্তত ১০টি গরু পরিবহন করা যায়। এদিকে ট্রাক-লরি সংকটে আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্য পরিবহনেও নানা সংকট সৃষ্টির কথা সরকারকে অবহিত করে যে কোনো কৌশলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পযাের্য় আনার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীষর্ সংগঠনের নেতারা। গত সোমবার তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কারণে এক সপ্তাহ ঠিকমতো পোশাকশিল্পের আমদানি ও রপ্তানি পণ্য আনা-নেয়া সম্ভব হয়নি। এতে বন্দরের কন্টেইনার ভতির্ রপ্তানিযোগ্য পণ্য পড়ে আছে। আর জাহাজীকরণের অপেক্ষায় কারখানায় পড়ে আছে তৈরি পণ্য। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প।’ বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘যখন অ্যাকডর্-অ্যালায়েন্সের শতর্গুলো পূরণ করে নিজেদের মতো করে চলার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখন এ ধরনের পরিস্থিতি আমাদের পিছিয়ে দেয়, ক্রেতাদের আস্থাহানি ঘটে এবং শিল্পের ভাবমূতির্ ক্ষুণœ হয়। তাদের দেশের স্বাথের্ পরিস্থিতি স্বাভাবিক পযাের্য় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছি।’ সংগঠনের অপর এক সাবেক নেতা বলেন, ‘ওই সংকট যদিও শিগগিরই কাটিয়ে ওঠা যেত, তবে তার আগেই সরকার বিশেষ ট্রাফিক অভিযান শুরু করায় ব্যবসা-বাণিজ্যে আরো বড় ধাক্কা লেগেছে। গাড়ির ফিটনেস ও চালকের উপযুক্ত লাইসেন্স না থাকার কারণে বিপুলসংখ্যক ট্রাক-লরি রাস্তায় না চলায় অনেক কারখানা স্টকলট এর শিকার হবে। তখন অনেক কারখানা বিমানে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হবে। এর মাশুল দিতে হবে পোশাকশিল্পকে।’ চলমান পরিস্থিতির দ্রæত অবসান দাবি করে ওই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, পরিবহন খাতের দীঘির্দনের অনিয়ম-দুনীির্ত দু-চার দিনে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। তাই দেশের অথৈর্নতিক পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে এ অব্যবস্থাপনা ধীরে ধীরে দূর করতে হবে। যা ব্যবসা-বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।