ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন

বিদ্রোহী নিয়ে দুশ্চিন্তায় আ'লীগ

৩১ ওয়ার্ডে শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী তাদের সরানোর চেষ্টায় হাইকমান্ড দেওয়া হচ্ছে পদ-পদবির প্রতিশ্রম্নতি সরে না দাঁড়ালে কঠোর ব্যবস্থা দ্বিধাবিভক্ত নেতাকর্মী-সমর্থকরা

প্রকাশ | ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
নির্বাচন এগিয়ে আসার পরও ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিপুলসংখ্যক বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাঠ না ছাড়ায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে অস্বস্তি ক্রমেই বাড়ছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় দলের নেতারা। বিশেষ করে দুই সিটির অন্তত ডজন তিনেক ওয়ার্ডে শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় সেখানে বিএনপির দুর্বল প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও দলীয় প্রার্থীকে জেতানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এদিকে দল সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে বিদ্রোহী হিসেবে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ভোটের মাঠে তৎপর থাকায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। এছাড়া যেসব ওয়ার্ডে বিতর্কিত ব্যক্তিকে কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে, সেখানকার নেতাকর্মীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। সেখানকার দলের ক্লিন ইমেজের বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী করলে তা রাজনৈতিকভাবে দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত তারা। অন্যদিকে যেসব ওয়ার্ডে দল সমর্থিত বিতর্কিত প্রার্থীর বিপরীতে ক্লিন ইমেজের দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী নেই, ওইসব ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা আরও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। কেননা চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক বাণিজ্য ও জুয়ার বোর্ড পরিচালনাসহ বিভিন্ন অপরাধ-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউন্সিলর প্রার্থীকে দল সমর্থন দিলেও তিনি বিজয়ী হওয়ার পর এলাকার পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে- এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দলের একনিষ্ঠ সমর্থকরাও অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিতর্কিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইতে গেলে তারা প্রচারণাকারীদের নানা কটু কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে রাগে-ক্ষোভে বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করছেন। আবার কেউ কেউ এ ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত নিলেও মুখে ভিন্ন কথা বলছেন। যদিও দলীয় হাইকমান্ডের ধারণা, স্থানীয় নেতাকর্মীরা মুখে যে কথাই বলুক না কেন, ভোটের দিন তারা দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীকেই নিশ্চিত ভোট দেবেন। প্রচারণার মাঠেও তারা দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সোচ্চার থাকবেন। দলের মুষ্টিমেয় নেতাকর্মী বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও তাতে দলীয় প্রার্থীর বিজয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না বলে মনে করেন তারা। তবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার মাঠ পর্যবেক্ষণকারীরা এ বিষয়টির এতটা সরল সমীকরণ সহজেই মেনে নিতে পারছেন না। তাদের আশঙ্কা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিপুলসংখ্যক ওয়ার্ডে ক্লিন ইমেজের শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী আসন্ন নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। তারা অনেকে জয়ী হতে না পারলেও বিরোধীদলীয় প্রার্থীর জয়ের ক্ষেত্রে তারা বড় অনুঘটক হবে বলে আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষণকারীরা। তাদের এ আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয় তা ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যেসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর বাইরে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে, ওইসব ওয়ার্ডের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে তা বেশ খানিকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। সোমবার দুপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে বিপুলসংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মামুন রশিদ শুভ্রর পক্ষে মিছিল ও জনসংযোগ করছেন। তারা তার পক্ষে দল ধরে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে লাটিম মার্কায় ভোট চাইছেন। এসব টিমের নেতৃত্বে সাবেক ছাত্রলীগের নেতারা কাজ করছেন। বেশকিছু টিমের অগ্রভাগে মূল দলের নেতারাও রয়েছেন। দলীয় প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর গোলাম আশরাফ তালুকদারের পক্ষে প্রচারণায় না নেমে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, ক্লিন ইমেজের যোগ্য নেতা হিসেবে প্রথমে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সাবেক উপ-তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ম ম মামুন রশিদ শুভ্রকে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। পরে নাটকীয়ভাবে তা প্রত্যাহার করে বর্তমান কাউন্সিলর গোলাম আশরাফ তালুকদারকে সমর্থন দেওয়া হয়। অথচ তার বিরুদ্ধে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি থাকাকালে নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। এ নিয়ে স্থানীয় ভোটারদের পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও নানা প্রশ্ন রয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে মামুন রশিদ শুভ্র বিপুল ভোটে জয়ী হবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তারা। স্থানীয় ভোটাররা জানান, দলীয় চাপে বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ তালুকদারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিলেও তারা কেউ কেউ গোপনে ভোটারদের লাটিম মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। উভয় সংকটে পড়ে দায়িত্বশীল অনেক নেতা কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠ থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আওয়ামী সমর্থক ভোটার ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, দল থেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানকে কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে। দলীয় সমর্থক হিসেবে তিনি ও তার পরিবারের সবাই তাকেই ভোট দেবেন। তবে এ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল আমিন এবং ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম তোড়জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা ব্যক্তিগত ইমেজের বাইরে বেশকিছু দলীয় ভোটও টানবেন। অনুমানিক হিসেবে দলীয় ভোট এই তিন প্রার্থীর মধ্যে সমভাগে ভাগ না হলেও মোট ভোটের অন্তত ৪০ শতাংশ দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর ঝুলিতে ঢুকবে। অথচ এ ওয়ার্ডে বিএনপির পক্ষে আলাউদ্দিন আহমেদ একমাত্র প্রার্থী। ফলে দলীয় ভোটের পাশাপাশি এন্টি আওয়ামী লীগের ভোট তার পক্ষেই পড়বে। এতে বিএনপির প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি বলে মনে করেন জাহিদুল ইসলাম। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ও কর্মীও একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, এখুনি বিদ্রোহীদের দমন করা না গেলে ভোটের মাঠে এর খেসারত দিতে হবে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন নেতাদের অনেকেই। এদিকে ঢাকা দক্ষিণের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের একই দশা। সেখানে আওয়ামী লীগের নিউমার্কেট থানা কমিটির সহসভাপতি আ স ম ফেরদৌস আলম কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন পেলেও শক্তিশালী বিদ্রোহী প্রার্থী ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন প্রচারণার মাঠ রীতিমতো কাঁপিয়ে তুলেছেন। স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ তার পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এ নিয়ে আওয়ামী সমর্থিত ভোটাররা রীতিমতো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। নির্বাচনে তারা কাকে ভোট দেবেন তারা তা স্থানীয় নেতাদের কাছে জানতে চাইছেন। এ সুযোগে বিএনপিদলীয় একক প্রার্থী নিউমার্কেট থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারির গলায় জয়ের মালা উঠবে কি না তা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদ্রোহী প্রার্থীও নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। তাদের ভাষ্য, ভাটাররা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসহাক মিয়াকে দলীয় সমর্থন দেওয়া হলেও বিদ্রোহী প্রার্থী ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফুল ইসলামও দলের বিপুল ভোট নিজের দিকে টানবেন। দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যকার ভোট ভাগাভাগির সুযোগে বিএনপির প্রার্থী শাহিনুর আলমের জয়ী হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরানোর দৃশ্যমান তেমন কোনো তৎপরতা দেখা না গেলেও ভেতরের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য তাদের দলীয়ভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কাউকে কাউকে আগামীতে লোভনীয় পদ-পদবি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসব প্রস্তাবে রাজি না হলে সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে দলীয় হাইকমান্ডের এমন হুমকিও রয়েছে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক তোফায়েল আহমেদ এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, 'যারা দলের সমর্থন পেয়েছেন তারাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী। এর বাইরে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন, তাদের অনুরোধ করা হচ্ছে, চেষ্টা করা হচ্ছে বসিয়ে দেওয়ার। আশা করি, এ নিয়ে কোনো সমস্যা থাকবে না।' ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, কেন্দ্রের নির্দেশে তারা এ নিয়ে সর্বাত্মক তৎপরতা শুরু করেছেন। তালিকা করে প্রত্যেক ওয়ার্ডের সব বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গেই যোগাযোগ করে তাদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করছেন। দলীয় নির্দেশনা মেনে যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ দেওয়া হবে। আবার থানা ও ওয়ার্ড সম্মেলনগুলোতেও তাদের ভালো পদেই বসানো হবে। আর যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি, ভবিষ্যতে তাদের কোথাও জায়গা হবে না।