গোয়েন্দা প্রতিবেদন-১

শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেট

গত বছরের শেষের দিকে ওই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে আবারও তালিকাটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়

প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
প্রতীকী ছবি
রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ভয়াবহ মাদক বিক্রির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। যার বেশিরভাগই নেতৃত্বে রয়েছেন ছাত্র ও একটি সংগঠনের সাবেক নেতারা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মচারীরাও জড়িয়ে পড়েছেন এই পেশায়। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজ ও ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে একটি ছাত্র সংগঠনের ১৬ জন সাবেক নেতা ও একজন থানা যুব সংগঠনের এক সদস্যের নাম রয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ এলাকায় মাদক বিক্রিতে সহায়তা করার জন্য দুইজন পুলিশ সদস্য জড়িত বলেও প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি যায়যায়দিনের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমরা প্রতি তিন মাস পরপর তালিকা তৈরি করি। এরপর ওই তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকা ধরেও সমন্বয় করে কাজ করা হয়। ওই তালিকায় কারও দলীয় পরিচয়ও উঠে আসতে পারে। মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।' তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছরের শেষের দিকে ওই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে অপর একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে যাচাই-বাছাই শেষে আবারও তালিকাটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। পাশাপাশি ওই তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে সরকারের অন্য সংস্থাগুলোকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত জনবল ও আনুষঙ্গিক সাপোর্ট না থাকার কারণে তাদের গ্রেপ্তারে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হলসহ ক্যাম্পাসে ছয়জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। তারা হচ্ছে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৭ম ব্যাচের মো. পারভেজ. ফিন্যান্স বিভাগের ৮ম ব্যাচের মো. সৌরভ, অর্থ বিভাগের ৯ম ব্যাচের মো. তুষন, ব্যবস্থা বিভাগের জুয়েল, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ১০ম ব্যাচের মো. সম্রাট আলম ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটোরিয়ার কর্মচারী আনোয়ার হোসেন। ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদক ব্যবসা ও সরবরাহকারীর তালিকায় সুজাউদ্দিনের তুহিনের নাম। তিনি একটি ছাত্র সংগঠনের ধানমন্ডি থানার সভাপতি। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশলাল ইউনিভার্সিটিতে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় আশফাক হোসেন নাম রয়েছে এক নাম্বারে। এ ছাড়া ২৮ কাঁঠাল বাগানের রাশেদুর রহমান, ১০৮ পান্থপথের মো. পাভেল, উত্তরা পূর্বাচলের মো. রিপন মিয়া, উত্তরা পূর্ব থানা এলাকার শিবলু, গ্রিন রোডের মশিউল আলম সোহাগ ও ভূতের গলির মো. জসিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাদক ব্যবসায় সহায়তাকারীদের তালিকায় দুই পুলিশ সদস্যের নাম উঠে এসেছে। তারা হচ্ছে নিউমার্কেট থানার এসআই আবাকুর রহমান ও নিউমার্কেট পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মনির। ঢাকা কলেজ এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় দুইজনের নাম রয়েছে। তারা হচ্ছেন দক্ষিণখানের ফরিদ মার্কেট এলাকার সবুজ আলীর ছেলে মো. মামুন ও সদরগলী ঢাকা কলেজের মো. পলাশ। এই ক্যাম্পাসেও মাদক সরবরাহকারীদের সহায়তার তালিকায় নাম রয়েছে নিউমার্কেট পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মনিরের নাম। ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় এক নেতাসহ পাঁচজনের নাম উঠে এসেছে। তারা হচ্ছেন গনকটুলি কলোনির সুন্দর বাবুর স্ত্রী জামিলা, হাজারীবাগের রাইসুল ইসলাম রবিন, কালোনগরের রাজিব, মাজার বটতলা এলাকার মো. সোহেল ও গজমহলের আলাউদ্দিন। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের চারজনের নাম রয়েছে গোয়েন্দা তালিকায়। তারা হচ্ছেন মো. রাশেদুর রহমান, মো. পাভেল, মশিউর আলম সোহাগ ও মো. জসিম। উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনজন বহিরাগত মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে ওই তালিকায়। তারা হচ্ছেন উত্তরা ৪ নং সেক্টরের ১৩ নং রোডের ৩৪ নং বাসার মো. রিপন মিয়া, ৬ নং সেক্টরের ঈশা খাঁ রোডের শিবলু ও দক্ষিণখান এলাকার মো. মামুন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪ জন সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তারা হচ্ছেন ওয়াসিম ভূঁইয়া আলম, আশিকুল পাঠান সেতু, দারুস সালাম শাকিল, আপেল মাহমুদ সবুর, কামরুজ্জামান, মোজাহিদুল ইসলাম সোহাগ, মাহাবুবুল ইসলাম, রাশেদুল ইসলাম, নাজমুল হক, নিশিতা ইকবাল নদী, মেহেদী হাসান, আনোয়ার হোসেন অনু ও এহেতাশামুল আলম রুমি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব নামধারী মাদক ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসে অবস্থান করে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসায় করে আসছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠতি বয়সি ছেলেমেয়ের মধ্যে ইয়াবা সরবরাহ করে আসছে। তাদের টার্গেটে থাকে বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা। প্রথমে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। এরপর তাদের কৌশলে ইয়াবায় আশক্ত করে। পরে তাদের কাছেই মরণনেশা ইয়াবা বিক্রি করে। নির্দিষ্ট একটা চেইনের মাধ্যমে তারা এসব মাদকদ্রব্য সাপস্নাই করে থাকে। এজন্য তারা মোবাইল ফোনের ম্যাসেঞ্জার ও ইমো ব্যবহার করে থাকে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ব্যবহার করে। তাদের দ্রম্নত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার সুপারিশও করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় যায়যায়দিনকে বলেন, ছাত্রলীগের যেকোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী যদি মাদক ব্যবসায় বা সেবনের সাথে জড়িত থাকে তাহলে তা প্রমাণসাপেক্ষে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।