ঢাকার দুই সিটির ভোট

নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করবেন নারী ভোটাররা

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:১৩

সাখাওয়াত হোসেন
কয়েকজন নারী ভোটার -ফাইল ছবি

রাজপথ থেকে গলিপথ, অট্টালিকা থেকে বস্তি। বাস-লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন সবখানেই ছুটছেন মেয়রপ্রার্থীরা। বিনম্রভাবে হাত মেলাচ্ছেন ছোট-বড় সবার সঙ্গে, দোয়া চাইছেন মাথা পেতে। কেউবা প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছেন যানজট, জলাবদ্ধতা, মাদক ও হকারমুক্ত পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার। কারও নির্বাচনী ইশতেহার রয়েছে, ঢাকাকে বিশ্বের উন্নত শহরের কাতারে নিয়ে দাঁড় করার। দিনরাত একাকার করে দলেবলে ছুটছেন ভোটারদের মন জয়ে। অথচ যে নারী ভোটারের হাতে সিটির ভোটের জয়-পরাজয়ের চাবিকাঠি, তাদের আকৃষ্ট করার তেমন কোনো জোরাল প্রতিশ্রম্নতি নেই প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মেয়রপ্রার্থীদের কারও। যা মহানগরীর সচেতন নারী ভোটারদের ভীষণভাবে হতাশ করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীরা জানান, এবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল কী হবে তা অনেকটাই হাতে রয়েছে নারী ভোটারের। কেননা মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকই এবার নারী। তাই নগরপিতা হতে হলে মন জয় করতেই হবে তাদের। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, উত্তর সিটি করপোরেশন ৫৪ ওয়ার্ডে মোট ভোটকেন্দ্র ১ হাজার ৩১৮টি, ভোটকক্ষ ৭ হাজার ৮৪৬টি। এ সিটিতে ভোটারের সংখ্যা ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭০৬ জনই নারী। বাকি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৭ জন পুরুষ। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে মোট ভোটকেন্দ্র ১ হাজার ১৫০টি এবং ভোটকক্ষ ৬ হাজার ৫৮৮টি। মোট ভোটারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন। এর মধ্যে ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩ জন নারী এবং ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১ জন পুরুষ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীরা জানান, আগের চেয়ে নারীরা এখন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। আর এ কারণেই বিপুলসংখ্যক নারী ভোটার বরাবরের মতো এবারও সিটি নির্বাচনের ফলাফলে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। যদিও ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হলেও প্রার্থী পছন্দের ব্যাপারে নারীরা এখনো অসচেতন এবং প্রার্থীদের কার্যকর যোগাযোগের অভাবে তারা অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন। তবে যে প্রার্থী নারীর অধিকার, নিরাপত্তা এবং সার্বিক প্রগতিশীল উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রম্নতি দেবেন, তিনিই সহজে নারী ভোটারের মন জয় করতে পারবেন। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির কোনো মেয়রপ্রার্থী নারী ভোটারদের আকৃষ্ট করার মতো কোনো প্রতিশ্রম্নতি দেননি। পৈশাচিক এ ধর্ষণ ঘটনার পর মেয়রপ্রার্থীরা কেউ কেউ নারীবান্ধব নগরী গড়ার কথা বললেও তার মর্মার্থ ছিল অনেকটাই ক্ষুদ্র গন্ডিতে বন্দি। কারও কাছ থেকেই এ ব্যাপারে বিস্তৃত কোনো প্রতিশ্রম্নতি পাওয়া যায়নি। তবে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা নারী উন্নয়নের কথাই বলছেন। যা নারী ভোটারদের ততটা উৎসাহিত করতে পারেননি। কেননা সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর হিসেবে তার ক্ষমতা কতটা তা এখন অনেকেরই জানা। মহানগরীর নারী ভোটারদের আকৃষ্ট করার মতো মেয়রপ্রার্থীদের কোনো প্রতিশ্রম্নতি না থাকায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নারী সংগঠকরা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, গণপরিবহণ, আবাসন, বিনোদন ব্যবস্থা প্রভৃতি সূচকের আলোকে যাচাই করা হলে ঢাকাকে কোনোভাবেই নারীবান্ধব শহর বলা যায় না। বরং মহানগর ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন নারী। কর্মস্থল, রাস্তাঘাট, পরিবহণ, কাঁচাবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনোটাই নারীবান্ধব নয়। বরং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা শহর নারীর সঙ্গে বৈরী আচরণ করছে। অথচ এ ব্যাপারে মেয়রপ্রার্থীদের সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নির্বাচনী ইশতেহারে নেই, যা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন নারী সংগঠকরা। ঢাকার কর্মজীবী নারী ভোটাররা জানান, রাজধানীতে নারীদের আবাসন সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। পরিবারের বাইরে থাকেন এমন নারীদের জন্য তিলোত্তমা নগরী বরং বেশখানিকটা ভোগান্তির। ছাত্রী ও কর্মজীবী নারীদের পর্যাপ্ত হোস্টেল সুবিধা না থাকায় মেসে ও 'সাবলেট' হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয় গাদাগাদি করে। ভাড়াও গুনতে হয় চড়া। ব্যক্তিমালিকানাধীন হোস্টেলও নিরাপদ নয়। সেখানে শ্লীলতাহানি, নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে যেতে পাবলিক বাসে ওঠা নারীর জন্য যেন রীতিমতো যুদ্ধ। পিঠে হাত দিয়ে ঠেলে বাস হেলপারের ওঠা-নামার মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাসে ভিড় থাকলে নারীর জন্য বরাদ্দ করা আসন চলে যায় পুরুষের দখলে। 'সিট নেই' অজুহাতে নারীদের নিতে চায় না অধিকাংশ গণপরিবহণ। তাই পাবলিক বাসের জন্য নারীর অপেক্ষা প্রতিনিয়ত দীর্ঘতর হচ্ছে। অথচ ঢাকায় নারীদের জন্য বিশেষ বাস চালু থাকলেও তা নামমাত্র। এমন অনেক নজির আছে, নেহাত পরিবহণ সংকটের কারণে কর্মজীবী অনেক নারীই চাকরি থেকে ইশতফা দিচ্ছেন। অথচ আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির কোনো প্রার্থী এসব সংকটের কোনো সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেননি বলে অভিযোগ করেন কর্মজীবী নারী ভোটাররা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারী ভোটারদের অভিযোগ, নগরীর অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিরাপদ নয়। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই পর্যাপ্ত ও পরিচ্ছন্ন টয়লেট। আবার কর্মস্থলে নারীদের টয়লেটের অবস্থাও আরও ভয়াবহ। পাবলিক টয়লেট এতটাই নোংরা, যা কোনো সচেতন নারী কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারেন না। রাস্তাঘাটে নারীদের জন্য সিটি করপোরেশনের পৃথক টয়লেট থাকলেও তা অধিকাংশই থাকে তালাবদ্ধ। তাই একজন নারী কর্মজীবী ও শিক্ষার্থীকে সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার পর এ নিয়ে নানা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হয়। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত শহরে সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে রাস্তা-ঘাট, বাস-লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও বিভিন্ন লোক সমাগমস্থলে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা শৌচারের সুব্যবস্থা রয়েছে, যা ঢাকার নির্বাচিত মেয়ররা অনায়াসেই তৈরি করতে পারেন। এছাড়া কর্মজীবী মায়েদের সুবিধার জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরির প্রতিশ্রম্নতিও সিটি মেয়রদের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকতে পারে বলে মনে করেন সচেতন নারী ভোটাররা। রাজধানীর উত্তরা এলাকার ভোটার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উম্মে কুলসুম বলেন, নিরাপত্তার প্রশ্নে সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা সীমিত হলেও কাঠামোর মধ্যে থেকে যতটা সম্ভব মেয়র তা করতে পারেন। কমিউনিটি পুলিশিং, রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা- এসব ক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।