ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন

প্রচারণার কোলাহলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের লেখাপড়া শিকেয়

নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও নির্বাচন কমিশন কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
সাখাওয়াত হোসেন এসেছে এসেছে, আবার ইলেকশন; জিতবে নৌকা, জিতবে জনগণ; ১৬ কোটি মানুষের একটাই ডিসিশন; জিতবে নৌকা, নাই কোনো টেনশন; জয় বাংলা... জিতবে আবার নৌকা... সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে ঢাকার দুই সিটির পাড়া-মহলস্নার অলিগলি রাজপথে উচ্চৈঃস্বরে রাত-দিন টানা বাজছে এ নির্বাচনী থিম সং। কোথাও আবার বিএনপি দলীয় মেয়রপ্রার্থীর পক্ষে তীব্র আওয়াজে সাউন্ডবক্স কিংবা মাইকে রেকর্ডকৃত স্স্নোগান বেজে চলেছে- নারী-পুরুষ বাঁধছে জোট, ধানের শীষে দিব ভোট; উন্নয়নের মার্কা, ধানের শীষ মার্কা; মাগো তোমার একটি ভোটে, খালেদা জিয়া মুক্তি পাবে; আসছে দেশে শুভদিন, ধানের শীষে ভোট দিন...। রাত-দিন একাকার করে গানের সুর আর আবৃত্তির ঢঙের এ প্রচার-প্রচারণায় নির্বাচনের পরিবেশ উৎসবমুখর হয়ে উঠলেও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের লেখাপড়া রীতিমতো শিকেয় উঠেছে। এমনকি দিনে লেখাপড়ার চাপ কমিয়ে গভীর রাত জেগেও সে ক্ষতি তারা কিছুটা পুষিয়ে নেবে- এ সুযোগও তাদের নেই। এ অবস্থায় পরীক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও এ নিয়ে চাপা রাগে-ক্ষোভে ফুঁসছে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও নির্বাচন কমিশন কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছে। যদিও রিটার্নিং কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, মাঠপর্যায় থেকে নিয়মিত প্রতিবেদন নেওয়া হচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা কোথাও পাওয়া যায়নি। যদিও সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬ বলছে, 'নির্বাচন-পূর্ব অর্থাৎ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত কোনো প্রার্থী মিছিল বা শোডাউন করতে পারবেন না। বেলা ২টার আগে এবং রাত ৮টার পর মাইক বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী অন্য যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। একজন প্রার্থী একটি করে মাইক ব্যবহার করতে পারবেন। জনগণের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে, এমন কোনো সড়কে পথসভা করতে পারবেন না।' নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রার্থী কিংবা তার লোকজন এর বাইরে কেউ কিছু করলে তা সুস্পষ্টভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া আছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রচার-প্রচারণার নামে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থীরা বেপরোয়াভাবে এসব আচরণবিধি ভঙ্গ করে চললেও তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন মাঠপর্যায়ের নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীরা। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী আইমুন নাহারের মা সাদেকুন নাহার জানান, তার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় গত কয়েক মাস ধরে নিয়মিত ৭/৮ ঘণ্টা লেখাপড়া করে আসছিল। তবে ১০ জানুয়ারি থেকে ঢাকার দুই সিটির আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর তার সে পড়াশোনা রীতিমতো শিকেয় উঠেছে। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি সাউন্ডবক্স-মাইকে উচ্চৈঃস্বরে টানা নির্বাচনী থিম সং ও রেকর্ডকৃত স্স্নোগান বাজতে থাকায় সামান্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীব্র আওয়াজে শ্রবণশক্তিরও বারোটা বেজেছে। সাদেকুন নাহার জানান, তার বাসা ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সীমান্ত এলাকা রামপুরা থানা এলাকায় হওয়ায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার কোলাহলের ভোগান্তি আরও বেশি পোহাতে হচ্ছে। দুই সিটির দুই মেয়রের পাশাপাশি দুই ওয়ার্ডের ৭ কাউন্সিলর প্রার্থী ও ৫ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থী ডজন দেড়েক মাইক-সাউন্ডবক্স দিন-রাত সবসময় বাজিয়েই যাচ্ছেন। প্রার্থীরা একটি করে মাইক বাজালে তাতে নির্বাচনবিধি লঙ্ঘিত না হলেও এলাকাবাসীর অবস্থা কী তা সহজেই অনুমেয়- যোগ করেন সাদেকুন নাহার। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ অবস্থা শুধু রামপুরাতেই নয়, নির্বাচনী কোলাহলে গোটা নগরীই নরকগুলজার হয়ে উঠেছে। এসএসসি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা অনেকে এ ভোগান্তি সইতে না পেরে 'ত্রিপল নাইনে' ফোনও করেছেন। কেউ কেউ আবার নির্বাচনী প্রচারণা বিধি ভঙ্গের কথা সরাসরি বলতে গিয়ে হয়রানি-লাঞ্ছনার শিকারও হয়েছেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থী জানান, এসএসসি পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকায় বাসাতেই বসে মুখস্থ পড়া রিভিশন দিচ্ছি। কিন্তু প্রচার-প্রচারণার তীব্র আওয়াজে মুখস্থ পড়া আরও ভুলে যাচ্ছি। ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত এ ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হলে পরীক্ষার ফল কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কায় আছি আমিসহ অন্য সহপাঠীরাও। নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে প্রার্থীদের উচিত, নির্ধারিত সময়ের বেশি মাইক না বাজানো কিংবা অন্য কোনোভাবে শোরগোল সৃষ্টি না করা- যোগ করেন ওই শিক্ষার্থী। এদিকে নির্বাচনী কোলাহলে এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটার কথা স্বীকার করেছেন খোদ মেয়রপ্রার্থীরাও। এ প্রসঙ্গে গত শনিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়রপ্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে, তবে তা যতটা কম হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য তিনি তার নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও বাস্তবে কোথাও তার এ নির্দেশনার তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এদিকে শুধু থি সং কিংবা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার স্স্নোগানসংবলিত রেকর্ড বাজিয়েই প্রার্থীরা খ্যান্ত হচ্ছেন না, তারা প্রচারের সময় মিছিল ও শোভাযাত্রা করাসহ নানাভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। নগরীর যেকোনো এলাকায় ঘুরলেই তার চিত্র দেখা যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, গত ১৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম খিলগাঁও তালতলা মার্কেট এলাকায় নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। এর আগে সকাল ১০টা থেকেই সেখানে একটি হলুদ রঙের পিকআপ ভ্যানে দুটি বড় কালো রঙের সাউন্ড বক্সে উচ্চ শব্দে নির্বাচনী 'থিম সং' বাজতে থাকে। দেড় ঘণ্টা পর আতিকুল ইসলাম এসে সেখানে পথসভা করেন। এরপর একটি ছোট পিকআপ ভ্যানে চড়ে গণসংযোগ শুরু করেন। এ সময় মাইকে ও বড় সাউন্ড বক্সে উচ্চৈঃস্বরে স্স্নোগান ও মিছিল চলতে থাকে। এ বিষয়ে আতিকুল ইসলাম বলেন, 'এ রকম একটু হতে পারে। আমরা চেষ্টা করছি কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা যাতে না ঘটে। নির্বাচনী প্রচারে যাতে জনদুর্ভোগ না হয়।' অন্যদিকে মিছিল ও শোভাযাত্রা করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন বিএনপি দলীয় মেয়রপ্রার্থীরাও। গত ১০ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আওয়াল বিএনপির কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক নিয়ে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদের সামনে জমায়েত হন। তারা প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে রাস্তা আটকে মিছিল করেন। এ সময় সাউন্ড বক্স ও মাইকে উচ্চৈঃস্বরে নির্বাচনী স্স্নোগান বাজতে থাকে। যদিও তাবিথ আউয়াল নির্বাচনী আইন, আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।