নীরব ভোটই বিএনপির ভরসা!

প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
প্রচারণায় অংশগ্রহণকারী কয়েকজন
সাখাওয়াত হোসেন ভোটের মাঠে সক্রিয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, কৌশলে গ্রেপ্তার এবং পোস্টার ছিঁড়ে ফেলাসহ নানামুখী অভিযোগের মধ্য দিয়ে ঢাকার দুই সিটিতে বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা এক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ স্বল্পসংখ্যক সহযোগী নিয়ে দু-একদিন পর পর ঝটিকা মিছিলে নামলেও বেশির ভাগ প্রার্থীই ভাড়াটে কর্মী দিয়ে অলিগলিতে কিছু পোস্টার লাগানোর মধ্যেই প্রচারণার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তবে মেয়র-কাউন্সিলর সব প্রার্থীরাই দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নিয়মিত উঠান বৈঠক করছেন। নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাই যাতে সাধারণ ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি নির্বাচনী ডিজিটাল কারচুপি ঠেকাতে সর্বোচ্চ তৎপর থাকেন, সে ব্যাপারে নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। দলীয় হাইকমান্ডও এ বিষয়টি নিবিড়ভাবে মনিটর করছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের ধারণা, ঢাকার দুই সিটিতে দলের সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীর বাইরে বিপুলসংখ্যক নীরব ভোটার রয়েছেন। যারা নিরাপদে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে একচেটিয়াভাবে বিএনপিদলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট দেবেন। যা তাদের দলীয় প্রার্থীদের নিরঙ্কুশ জয় নিশ্চিত করবে। তাই নেতাকর্মীদের নিয়ে দলগতভাবে প্রচার-প্রচারণার মাঠে নেমে হামলা-নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়ে অযথা সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় না করে তা সরাসরি ভোটের দিন কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা করছেন তারা। দলের নীতি-নির্ধারকদের দাবি, নির্বাচনের মাঠে নেতাকর্মীরা সোচ্চার না হলেও তারা গোপনে নির্বাচনী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরপেক্ষ-নীরব ভোটারদের সিংহভাগই তাদের পাশে রয়েছে। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্য লড়াইয়ে না নামলেও গোপন ব্যালটে দাঁতভাঙা জবাব দেবে। ভোট ডাকাতি বা ফল কারচুপি না হলে দুই সিটিতে বিএনপিদলীয় দুই মেয়রসহ বিপুলসংখ্যক কাউন্সিলর অনায়াসেই জয়ী হবেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, পুলিশি হয়রানি ও ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের ভয়ে বিএনপিদলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীরা জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণার মাঠে নামতে ভয় পাচ্ছেন। মামলা-হামলার অজানা আতঙ্কে তাদের ঘনিষ্ঠজন, পরিবারের সদস্যরাও এ কর্মযজ্ঞ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। এমনকি ভাড়াটে কর্মীরাও তাদের পক্ষে কাজ করতে চাচ্ছেন না। এ অবস্থায় ভোটের বার্তা নিয়ে মাঠে নামার চেয়ে নির্বাচনী সুষ্ঠু পরিবেশের ক্ষেত্র তৈরির দিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি গত টার্মে খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল ভোটের দিন দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে টিকে থাকতে না পারা। বিশেষ করে কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট নিয়োগের ব্যর্থতা আওয়ামীদলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট ডাকাতির বড় সুযোগ এনে দিয়েছে বলে মনে করেন তারা। কেন্দ্রীয় নেতাদের আশঙ্কা, এখন থেকে তারা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নামলে সরকার আগের মতোই সক্রিয় নেতাকর্মীদের ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরবে। এতে ভোটের দিন বিএনপি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্ট জোগাড় করা কঠিন হবে। এ সুযোগে আওয়ামী দলীয় প্রার্থীরা বিগত সময়ের মতো অবাধে ভোট ডাকাতির সুযোগ পাবে বলে মনে করেন দায়িত্বশীল ওই নেতারা। তাদের এ আশঙ্কা অমূলক নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও। তাদের ভাষ্য, দলটির মূল শক্তি হচ্ছে নীরব ভোটার। এরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মতো রাজপথ কাঁপাতে পারে না। তবে কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পেলে তারা নির্বিঘ্নে 'ভোটবিপস্নব' ঘটিয়ে দিতে পারে। যা অতীতের বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলেই বিএনপির এই শক্তি সম্পর্কে আন্দাজ করা যাবে। তবে এই শক্তি কাজে লাগাতে চাইলে বিএনপিকে আরও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তাদের পরামর্শ- অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির উলেস্নখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। অথচ দেশের চার কোটি তরুণ ভোটারের সিংহভাগ এখন ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলটির শক্ত অবস্থান গড়তে হবে। যেসব ইসু্যতে জনগণের আগ্রহ আছে, সেসব ইসু্য নিয়ে কাজ করতে হবে। বিএনপি যে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছে, তা জনগণকে বোঝাতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। সিটি নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণার বিষয় জরুরি হলেও তা মুখ্য নয়। কারণ ভোটাররা সবাই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ কতটা আছে তা-ও কারও অজানা নেই। তাই ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবেন। অন্যদিকে সচেতন ভোটাররা মনে করেন, এবার সিটি নির্বাচনে প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ বড় কোনো ফ্যাক্টর হবে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করেই ভোটাররা ভোট দেবে। তবে এককভাবে কোনো দল নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করবে, নাকি ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে তা ভাগাভাগি হবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি তারা। তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুই দলেরই নেতাকর্মী প্রায় সমানে সমান। তাই নিরপেক্ষ নীরব সমর্থকদের ভোট যেদিকে ঝুঁকবে, সে দলই বিজয়ী হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত নীরব ভোটাররা সিটি নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারবে কি না তা নিয়েও সন্দিহান তারা। তাদের ধারণা, আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার ছক কষে দীর্ঘদিন ধরে নানা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তাই হুট করে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনের মাঠ দখল কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এদিকে নীরব ভোটে জয়ের আস্থা থাকলেও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা থেকে সরে থাকার কথা অস্বীকার করেছে বিএনপি হাইকমান্ড। তাদের ভাষ্য, নির্বাচনী আইন ভেঙে কোনো তৎপরতা না চালালেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনী মাঠে সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকার দুই সিটিতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির পক্ষে ঐতিহাসিক ভোট-বিপস্নব ঘটবে। কোনো ষড়যন্ত্র করে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। ভোটে কারচুপি হলে ঢাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি তা কঠোর হাতে দমন করবে বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে বিএনপিদলীয় মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাদের হুমকি দিচ্ছে। সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের আক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ নির্বাচন কমিশন নির্বিকার রয়েছে। সার্বিক অবস্থায় এটি স্পষ্ট, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে আবারও ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের মতোই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রহসনের নির্বাচন করতে চায় বর্তমান অবৈধ শাসকগোষ্ঠী। এ ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ, দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো গন্তব্য নেই- যোগ করেন বিএনপিদলীয় এই শীর্ষস্থানীয় নেতা। এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা কিছুটা দুর্বল হলেও ঢাকার দুই সিটিতে তাদের বিরাট ভোট ব্যাংক রয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে হয়তো তার প্রমাণ মিলবে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ভোটাররা কোনোভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বেকায়দায় পড়বে বলে মনে করেন তারা।