প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মৃত ৪১, সতর্ক বাংলাদেশ

প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০৯

যাযাদি ডেস্ক
চীনের বিভিন্ন বিমানবন্দরে করোনাভাইরাস পরীক্ষা -যাযাদি
নতুন, নিউমোনিয়া-সদৃশ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার নেপালেও ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। এদিকে এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ রোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অন্যদিকে মহামারি ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে চীনসহ ১২ দেশে নতুন এ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। এক দিনের ব্যবধানে মৃতের সংখ্যাও ২৬ থেকে বেড়ে ৪১ হয়েছে বলে চীনের কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। নিহতদের মধ্যে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইরত এক চিকিৎসকও আছেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে। হুবেইর উহানে জিনহুয়া হাসপাতালের ৬২ বছর বয়সি চিকিৎসক লিয়াং ?উডংয়ে মৃতু্যর খবর জানিয়ে টুইট করেছে চীনের গেস্নাবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক। উহানেই প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটির প্রথম দেখা মেলে। সংক্রমণের বিস্তৃতি ঠেকাতে গত কয়েক দিন ধরে শহরটিকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। চীনে ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা শনিবার পর্যন্ত এক হাজার ২৮৭তে পৌঁছেছে বলে দেশটির ন্যাশনাল হেলথ কমিশন নিশ্চিত করেছে। এর বাইরে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়ও আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। উহান থেকে ১৯ জানুয়ারি আসা এক চীনা নাগরিকের শরীরে করোনাভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে অস্ট্রেলিয়া। মেলবোর্নের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বয়স ৫০ এর ঘরে থাকা ওই ব্যক্তির পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলেও জানিয়েছে তারা। 'চীনের বাইরেও যে পরিমাণ আক্রান্তের খোঁজ মিলছে, আর উহান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসা মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় এটা অসম্ভব নয় যে আমরা এ ধরনের আরও কিছু আক্রান্ত ব্যক্তির খোঁজ পাবো,' সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রেন্ডন মারফি। শুক্রবার সন্ধ্যায় ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইউরোপে নতুন করোনাভাইরাসটিতে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তির উপস্থিতির খবর নিশ্চিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন জানিয়েছে, তারা প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ৬৩ জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন; এর মধ্যে দুই ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। আক্রান্ত দুই ব্যক্তিই উহান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন, বলেছে তারা। চীনে পড়তে যাওয়া এক শিক্ষার্থীর দেহে ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়ার কথা জানিয়েছে নেপাল। শুক্রবার এক ঘোষণায় দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এ কথা জানায়। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষও তিন নাগরিকের শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্তের তথ্য দেয় বলে স্ট্রেইট টাইমস জানিয়েছে। গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) নতুন এ করোনাভাইরাসটির কারণে চীনে জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে ঘোষণা করলেও, এখনি আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেনি বলে জানিয়েছিল। নতুন চান্দ্রবর্ষ উদযাপন সামনে রেখে ঘরমুখী মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার থেকে চীন ১০টি শহরে গণপরিবহণ ও সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর মন্দির বন্ধ করে দিয়েছে। পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য 'নিষিদ্ধ শহর' ও গ্রেট ওয়ালের একটি অংশও বন্ধ রাখা হয়েছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে। চীনা নববর্ষের সপ্তাহব্যাপী ছুটির মধ্যে দেশটির কোটি কোটি মানুষ একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাতায়াত করলে ভাইরাসটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গণপরিবহণ বন্ধ করায় উহান ও পার্শ্ববর্তী হুয়াংগ্যাং শহরের অন্তত ২ কোটি কার্যত আটকা পড়েছে। উহানের সঙ্গে বিমান ও রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উহানের সর্বত্র 'ফেইসমাস্ক' পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে শহরটি একটি ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে বলে বাসিন্দারা বিবিসিকে জানিয়েছেন। বেইজিংয়ে সব বড় উৎসব ও মন্দিরের মধ্যে মেলা নিষিদ্ধ এবং চলচ্চিত্র মুক্তি স্থগিত করা হয়েছে। শনিবার থেকে বন্ধ হচ্ছে সাংহাইয়ের ডিজনিল্যান্ডও। সতর্ক বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী নভেল করোনা ভাইরাসে (২০১৯-হঈড়ঠ) আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ বেড়েই চলেছে। এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। তবে এ রোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ ও কর্মপরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের কোনো রোগী পাওয়া যায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি ক্রাইসিস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ১৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও আরও ১০ জনকে নিয়োজিত করা হয়েছে। তা ছাড়া একজন নার্স ও একজন চিকিৎসককে এ কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে আসা প্রত্যেক রোগী থার্মাল ক্যামেরা স্ক্যানার ছাড়া প্রবেশ করতে পারছেন না। এ স্ক্যানারে যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে স্ক্রিনে লাল দেখাবে। তখন ওই যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হয়। তাছাড়া যেসব দেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে-বিশেষ করে চীনসহ থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে আগত যাত্রীদের স্ক্রিনিং না করে বিমানবন্দর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, এ অবস্থায় বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত নয়। তবে মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থল/নৌ ও বিমান বন্দরসমূহে ইমিগ্রেশন ও আইএইচআর স্বাস্থ্য ডেস্কসমূহে সতর্কতা এবং রোগের সার্ভিলেন্স জোরদার করা হয়েছে। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন প্রবেশপথসমূহে নতুন করোনা ভাইরাস স্ক্রিনিং কার্যক্রম চালু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'নতুন ভাইরাস সম্পর্কে ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধের জন্য রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত প্রচার কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়েছে।' ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সাতটি প্রবেশপথে ডিজিটাল থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে আক্রান্ত দেশ থেকে আগত রোগীদের স্পর্শ না করে জ্বর পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে প্রস্তুত রয়েছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য রেফারেল হাসপাতাল হিসেবে নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। চিকিৎসা কাজে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রোগপ্রতিরোধী পোশাক মজুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড। বিমানবন্দরের ভেতরে আক্রান্ত রোগীদের দ্রম্নত শনাক্তকরণের জন্য ক্রুদের মাধ্যমে যাত্রীদের মধ্যে হেলথ ডিক্লারেশন ফর্ম ও প্যাসেঞ্জার লোকেটর ফরম বিতরণ করা হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইন এবং রোগীর স্ক্রিনিং ব্যবস্থা জোরদারসহ চীন ও আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আক্রান্ত যাত্রীদের হেলথ ফরম দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসাবিষয়ক সহায়তার জন্য চারটি হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব নম্বর হচ্ছে-০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫। এদিকে হটলাইন নম্বরগুলোতে অনেকেই যোগাযোগ করছেন বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেবরিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, আমাদের অনেকেই ফোন দিচ্ছে। করোনা ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত কিনা সেটা টেস্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট আমাদের কাছে সরবরাহ রয়েছে। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। আমরা সবাইকে বলছি ১৪ দিন পর্যন্ত নিয়মিত চেকিংয়ে থাকুন। এ রোগের প্রকোপ ১৪ দিন পর্যন্ত থাকে। 'আমরা এ পর্যন্ত দুইজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের ল্যাবে করিয়েছি। তারা এ রোগে আক্রান্ত নয়। তা ছাড়া অন্যান্য দেশের এ রোগের চিকিৎসার ডাটা কালেক্ট করে অ্যানালাইসিস করেছি। এ রোগের মূলত কোনো চিকিৎসা নেই। নরমাল জ্বর ঠান্ডার চিকিৎসাই এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা,' যোগ করেন ডা. ফ্লোরা। চীনে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন চীনে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশটিতে বসবাসরত বা ভ্রমণরত বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন চালু করা হয়েছে। এর নম্বর (৮৬)-১৭৮০১১১৬০০৫। বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস এ হটলাইন চালু করেছে বলে শনিবার এক বার্তায় জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। ফেসবুকে দেওয়া ওই বার্তায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের কর্মকর্তা খায়রুল বাসার এবং আসিফ বাংলাদেশিদের করা ২৪৫ সদস্যের উই চ্যাট (মোবাইলে ভয়েস চ্যাটের জনপ্রিয় অ্যাপ) গ্রম্নপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। বিশেষ করে উহান শহরে সরকার কাউকেই বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছে না, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে। বিচলিত না হয়ে সরকারি নির্দেশ মেনে চলার জন্য সবাইকে বলা হয়েছে।' করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে এখন পর্যন্ত ৪১ জন মারা গেছেন। দেশটির হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকেই ভাইরাস ছড়িয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এমনকি ভারতেও পৌঁছে গেছে। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এ শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রেখেছে চীন। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আটকা পড়েছেন অন্তত ৫০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। উহানে আটকে পড়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন।